হাসান আজিজুল হকের ‘শকুন’ গল্প পড়ে আমি পড়ে আমি বিভ্রান্ত। ওপার বাংলার বরেন্দ্রভূমিতে বসে লেখক রাঢ়ভূমির গল্প লেখেন কী করে?
চটজলদি সিদ্ধান্ত, আমি রাজশাহী যাব। লেখকের সঙ্গে দেখা করব।
বন্ধু আসমহম্মদকে বলি ব্যাপারটা। সে আমার ব্যবস্থা করে দেয় রাজশাহী যাওয়ার। পরেরদিন আমি রাজশাহীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। আমার লালগোলা, তার পাশেই বিশাল পদ্মার চর। চরে একটা বাংলাদেশী গ্রাম, নাম কোদালকাটি। সেটা পেরুলেই পদ্মা। আর পদ্মার ও পাড়েই গোদাগাড়ি। একটা গঞ্জ। রাস্তা কিন্তু ঝা তকতকে। বাস এল, আমি উঠে পড়লাম তাতে। পরের স্টপ রেলবাজার। সেখানে একটা মাজার আছে। বাস ঘিরে মাজার কমিটির লোকেরা মাজারের উন্নতি কল্পে চাঁদা চাইছে। দিলাম। ভিনদেশে যাতে কোনও বিপদে না পড়ি।
অথচ রাজশাহী পৌঁছে আমার চক্ষু চড়কগাছ! চারপাশে শুধুই পুলিশ। যাব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভয়ে ভয়ে একটা রিক্সা নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পৌঁছতেই আমার দম বন্ধ অবস্থা। সেখানে এতই পুলিশ যে, অগত্যা রিক্সা ফিরিয়ে চলে আসি নিরাপদ দূরত্বে।
বন্ধু আসমহম্মদ বলেছিল, তেমন কিছু অসুবিধা হলে একজনের ঠিকানা দিচ্ছি, চলে যাবি। আমার কথা বলবি। সেই সব ব্যবস্থা করে দেবে।
আমি রিক্সাবালাকে তার কথা বললাম। রিক্সাবালা নিমেষেই আমাকে সেখানে পৌঁছে দিল। পৌঁছে দিল মানে, একটা কানাগলি– সেটা পেরিয়ে রিক্সাবালা আমাকে যেখানে নিয়ে এল সেটা বস্তি মতো একটা কিছু। অন্তত আমার তাই মনে হল। আমি অনেক বস্তি দেখেছি। আমার বাড়ির চারপাশেই ৪৭/৭১–এর দেশ ছেড়ে আসা মানুষের বাস। যাঁরা আজকেও খলপার টাটির ঘর, ওপরে করগেট টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরে বাস করেন।
সেরকম বস্তির মধ্যে একটা বাড়ি। জরাজীর্ণ। সেই বাড়ির দরজায় নয়, একবারে ঘরের মধ্যে আমাকে ঢুকিয়ে দিল সেই রিক্সাবালা। ঘরের ভেতরটা আবছা। কেমন সব এলোমেলো। অগোছালো। তেমন ঘরে যে মানুষটি আমাকে আপ্যায়ন করল, তার নাম আমি ভুলে গেছি। তবে আমার সম্পর্কে সব জেনে সে যা বলল, তা অনেকটা এরকম– বছেন ভাই। একটুখানি জিরান ল্যান। ছরিবত খান। আপনার চিন্তার কোনও কারণ নাই। আমি আসি। আছমহম্মদভায়ের দোছত আপনি, মানে আমার দোছত। মুনে করেন, এই বাড়ি আপনার নিজের বাড়ি।
লোকটা যত সহজে এবং যেভাবে বলল, আমার মাথায় ঢুকল না। আমাকে কোথায় বসাবে তাও ভাবল না। ততক্ষণে একজন মহিলা বড় একটা ফুলতোলা কাঁচের গেলাসে সরবত নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। লোকটি আমাকে বলল, ল্যান ভাই ধরেন– ছরবত খান।
মহিলা নিশ্চয় লোকটির বউ। আমি অনুমান করি। কিন্তু বুঝতে পারি না, মহিলা একজন অপরিচিত পরপুরুষের সামনে এত স্বাভাবিক হয় কী করে?
এর মধ্যে মহিলাকে ঘিরে ধরেছে একগোণ্ডা বালবাচ্চা। তারা কিলবিল করছে। বলছে, মা ছরবত খাবো – মা ছরবত খাবো! জোর পিয়াস লেগ্যাছে।
এই দৃশ্য দেখে আমার হাতের সরবতের গেলাস হাতেই থেকে যায়। মুখে তুলতে পারি না। বাচ্চাদের দিকে খেয়াল নেই মহিলার। মেহেমানকে নিয়েই ব্যস্ত সে। মেহেমানের দেশে তার বাপের বাড়ি। বর্ডার পেরিয়ে সে বহুদিন বাপের বাড়ি যেতে পারেনি। সে দুঃখ মেহেমানকে শোনাতে চায়। জানতে চায় তার মা–বাবা কেমন আছেন? কিন্তু মেহেমান সরবতের গেলাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে যে! বসতে জায়গা দেয়নি। হঠাৎ সেটা খেয়াল হতেই শরমে আপন মনে ছিঃ ছিঃ বলে উঠল মহিলা। তারপর ছুটে গেল ঘরের বাইরে। মেহেমানকে বসতে দেবার জন্য কিছু একটা আনতে বোধহয়।
লোকটা এতক্ষণ ঘরে ছিল না, কথা বলতে বলতে কখন বাইরে বেরিয়ে গেছিল, আবার ফিরে আসতেই আমি তাকে খেয়াল করলাম। লোকটা ঘরের কোনায় থাকা আলমারি থেকে কী বের করতে করতে বলছে, জলদি করেন ভাই। ভারছিটির ক্লাস শুরুর আগেই আপনার হাছানছাহেবেরে ধরতি হবে। নাকি খুব দরের মানুষ। ছময়ের দাম বোঝেন। আমি খোঁজ নি আইলাম। আপনি জলদি জলদি ছরবতটা খাইয়া ল্যান।
এবারে আমি আর সরবত হাতে ধরে রাখতে পারি না, এক চুমুকেই খেয়ে ফেলি। আমার তৃষ্ণা লেগেই ছিল। ধূ ধূ বালির চরের ওপর দিয়ে প্রায় ঘণ্টা খানেক হেঁটে আসা চারটি খানি কথা নয়। তবু হেঁটে এসেছি। হাসান আজিজুল হক নামের এক গল্প লেখকের টানে। বরেন্দ্রভূমির একজন লেখক রাঢ়ভূমির পটভূমিতে ‘শকুন’ নামের গল্প লেখেন কী করে? বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া এমন গল্প লেখা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাছাড়াও ওই গল্পের চরিত্রগুলির মধ্যে আমি নিজেও একজন। আমি পড়াশোনার পাশাপাশি রাখালিও করেছি। রাখালবালকদের সঙ্গে ঠিক গল্পের মতোই শকুন মেরেছি। শুধু তাই না, গল্পের চরিত্র যে ভাষায় কথা বলছে, আমি নিজেও সেই ভাষায় কথা বলেছি আমার শৈশব–কৈশরে। অথচ ভাষার চরিত্র হচ্ছে প্রতি দশ কিমি অন্তর বদলে যাওয়া। তাহলে এটা সম্ভব কী করে?
এইসব প্রশ্ন নিয়ে বিনা পাশপোর্টে বন্ধু আসমহম্মদের সহায়তায় আমি ছুটে এসেছি এই বিদেশবিভুঁইয়ে। যে দেশটাই আবার গণতন্ত্র নেই। সামরিক শাসকের অধীন। যেখানে সেখানে পুলিশ। অগত্যা এই লোকটির দ্বারস্থ।
বাড়ি থেকে বেরোতেই আমার চোখ পড়ে দরজার বাঁ–দিকের একটি পরিত্যক্ত জায়গার ওপর। ইটের প্রাচীর ঘেরা। প্রাচীর কোথাও একফুট দাঁড়িয়ে আছে তো কোথাও মটির সঙ্গে মিশে গেছে। মধ্যেখানে একটা শিবলিঙ্গ। পাশেই একটা বেলগাছ দাঁড়িয়ে। জায়গাটাকে ছায়া করে রেখেছে।
কানাগলি পেরিয়ে আমরা আবার বড় রাস্তায় উঠেছি। লোকটি একটা খালি রিক্সা দেখে হাঁক ছেড়ে ডাকল। রিক্সাবালা হাঁক শুনে এসে দাঁড়াল আমাদের পাশে। আমরা উঠে বসলাম তাতে। রিক্সা চলতে শুরু করল। সঙ্গে রিক্সাবালার বকবকানি, কোনে যাইবেন ভাই? ছঙ্গে মেহেমান দেখত্যাসি। ইন্ডিয়া থেইক্যা আইত্যাসে বোধায়। কে লাগে? ভাবীজানের ভাই নাকি?
বকবক না কইর্যা রিক্সা টান। ভারছিটি যাওন লাগবো। তার আগে নিজাম হোটেলে লিয়া চল।
ধমকের স্বরে বলল লোকটি।
রিক্সাটা আমাদের নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে এমন এক জায়গায় নিয়ে এল, অবাক না হয়ে পারলাম না। রাস্তার ধারে নয়নজুলির ওপর গোটা গোটা বাঁশের পাটাতন। তার ওপর সার সার খলপার টাটির ঝুপড়ি ঘর। ঘরগুলি আবার এক একটা হোটেল। কোনটার নাম ‘আমিনা’, কোনটার নাম ‘কোহিনুর’, কোনটার নাম ‘নিজাম’।
লোকটি বলল, নামেন ভাই– একটু নাছতা কইর্যা লিই।
বাড়িতে শুধু সরবত খাইয়ে রিক্সা চড়িয়ে হোটেলে নাস্তা খাওয়াবে ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে আমি কোনও কুলকিনারা পাচ্ছি না। বেবাক দাঁড়িয়ে আছি।
লোকটি আবার আমায় তাগাদা দিল, অগত্যা আমাকে একটি হোটেলে ঢুকতে হল লোকটির পিছু পিছু। ভিতরে বাঁশের পাটাতনের ওপর গজাল গেঁথে বেঞ্চ–হাই বেঞ্চ আটকানো। তাতে বসে অনেকেই খাচ্ছে। হোটেল–কর্মী, খরিদ্দারের হাঁটাচলায় পাটাতন দোল খাচ্ছে, কিন্তু কারও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। খরিদ্দার খেতে ব্যস্ত। হোটেল–কর্মীরা খাওয়াতে ব্যস্ত। অথচ আমার রীতিমতো ভয় করছে। বাঁশের পাটাতনের নীচেই বিশাল খাল। খালে জল কাদা সমান সমান। তার মধ্যে অসংখ্য কাক আর কুকুরের দাপাদাপি। কোনও কারণে পাটাতন ভেঙে পড়লে আর দেখতে হবে না, কাক–কুকুরে আমাদেরকেও ছিঁড়ে খাবে।
ইতিমধ্যে আমাদের সামনে নাস্তা পরিবেশিত হয়েছে। আমি খেয়াল করিনি। লোকটি যখন বলল, খেয়্যা ল্যান ভাই। ঠাণ্ডা মারলে আর খাইতে পারবেন না, তখন আমি দেখি আমার সামনে বড় একটা চিনামাটির প্লেটে তন্দুরি রুটি আর একটা বড় বাড়িতে পায়চা। পায়চা দেখে আমার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। গরুর গোটা ঠ্যাঙ সাজিয়ে দিয়েছে যেন। কিভাবে খাব? এতবড় হাড় মুখে লাগিয়ে মজ্জ্বা টানা যায় নাকি?
না, টানা যায় না। তবে খাওয়া যায়। আমি লোকটিকে দেখি, লোকটি তার বাঁ–হাতটা পায়চার বাটির ওপর রেখে ডানহাতে পায়চার বড় হাড়টা শক্ত করে ধরে বাড়ি মারছে। ওতেই মোটা হাড়ের ভিতর থেকে মজ্জ্বা খসে খসে পড়ছে বাটিতে। গল্পকারের খোঁজে এসে আমি যেন গল্পের খোঁজ পাচ্ছি। আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। হয়ত সেই আনন্দেই আমি লোকটিকে জিজ্ঞেস করে বসি, ভাই– বাড়ি ছেড়ে আপনি আমাকে এতদূরে হোটেলে নাস্তা করাতে নিয়ে এলেন কেন?
লোকটি বলল, দ্যাখেন নি ভাই আমার বাড়ির দরজায় একটা ছিবমন্দির আসে! আছলে ওই বাড়ি ছিল এক হিন্দু ভায়ের। আমার বাপের কাছে সে লোক ওই বাড়ি বিক্রি কর্যা ইন্ডিয়ায় চলে যায়। আমার বাপেরে বলে যায়, আর কিছু না পারেন– ছম্ভব হলে মন্দিরটার মান রাখিয়েন। তাই আমরা বাড়িতে গোমাংছ ঢোকায় না ভাই।
একথা শুনে শুধু আমি একা আনন্দিত হই না, আমি দেখি পাটাতনের নীচের জল–কাদায় অগুনতি কুকুর আনন্দে লটাপটি খাচ্ছে। কাকগুলি হোটেলের নীচের বদ্ধ হাওয়ায় মুক্ত মনে ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে লোকটির বাড়ির দরজার পাশে পরিত্যক্ত শিবমন্দিরে শিবলিঙ্গের মাথায় বসন্ত বাতাসে একটা দুটো বেলপাতা খসে খসে পড়ছে। জীব–প্রকৃতির সব আনন্দ উল্লাস ভেসে আসছে আমার কানে। আমার সব ভয় কেটে যাচ্ছে।