বালি আর নুড়িপাথর বেছানো রাস্তাটা শুরু হবে। জঙ্গলের একদম শেষপ্রান্তে এসে হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়লো কোশি। বাঁ হাতটা তুলে থামতে ইশারা করলো। মুহূর্তে বদলে গেছে শরীরী ভাষা। সতর্ক টানটান! বড়বড় চোখদুটো জ্বলছে আগুনের খাপড়ার মতো। হুবহু অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট জাতীয় চ্যানেলগুলোয় দেখা শিকার ধরার আগে বাঘিনী চিতা যেন। কান খাড়া করে কী যেন শোনার চেষ্টা করছে একমনে। দমবন্ধ নিস্তব্ধতা। জঙ্গলজুড়ে পক্ষীকুলের সম্মিলিত কনসার্টও যেন থেমে গেছে পরিস্থিতির গুরুত্ব আন্দাজ করে। অভিরূপ বুঝতেই পারছেনা হঠাৎই কেন পরিস্থিতি পাল্টে গেল এভাবে। কিছুক্ষণ পরে দূর থেকে ভেসে আসা একটা ‘গুট গুট’ আওয়াজ। একটানা। শব্দটার উৎস যে আকাশে, বেশ বোঝা যাচ্ছে সেটা। কোশির ইশারায় ঝটিতি মোটা মোটা থামের মতো গুঁড়িওয়ালা গাছগুলোর আড়ালে চলে গেল সবাই। আওয়াজটা জোরালো হচ্ছিল প্রতিমুহূর্তে। মিনিট দুয়েক বাদে একটা জলপাই সবুজরঙা হেলিকপ্টার, শব্দ তুলে উড়ে চলে গেল নদীর ওপর দিয়ে। মাথার ওপর ঘুরতে থাকা প্রপেলার কম্পন তুলছিল জলে। “নজরদার হেলিকপ্টার … গিধ(শকুন) কা তরহা উপ্পর সে তালাশি চালাতে হায় জঙ্গল মে।” কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করলো যতীন।
শব্দটা মিলিয়ে যাবার পরও অন্ততঃ পনেরো মিনিট ঠায় একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো দলটা। কোশির হাতের সংকেতে ‘অল ক্লিয়ার’ সিগন্যাল পাওয়ার পর ফের সচল হলো সবাই। অভিরূপ খেয়াল করলো স্কোয়াডের কারো কোমর বা কাঁধের অস্ত্র আর সস্থানে নেই। হাতে হাতে উঠে এসেছে। ‘ক্রিক ক্রিক’। ব্যারেল আর ম্যাগাজিন আনলক করার শব্দ। পায়ের তলায় নুড়িপাথরের আস্তরন। অথচ শব্দ হচ্ছেনা অ্যাতোটুকু। আওয়াজ যেটুকু উঠছে তা অভিরূপের পায়ের তলায়। একই সঙ্গে ভয়ঙ্কর রকম ভীত এবং লজ্জিত অভিরূপ। ওর জন্যই না মারাত্মক একটা কিছু ঘটে যায়। চাপাগলায় আশ্বস্ত করেছিল যতীন। “ঘাবড়াইয়ে মৎ কমরেড। আরামসে …।” এবার সামনে নদী। শীতকালে জল হাঁটু তবুও স্রোতের টান বেশ জোরালো। পাথর এখানে বড় বড়। অসমান, পিছল। পা হড়কে যাচ্ছে বারবার। যতীনের হাতটা সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরে জল ভাঙছে অভিরূপ। কয়েকবার তো পড়তে পড়তে বেঁচে গেল যতীন ধরে ফেলায়। প্রত্যেকবারই সেই ভরসামাখা সতর্কবাণী – “সামহালকে কমরেড, আরামসে …।”
ক্রমশ কমে আসছে জল, একই সঙ্গে স্রোতের টানটাও। পাড়ে উঠে ফের সেই নদী আর জঙ্গলের মাঝখানে একইরকম নুড়িপাথর ছাওয়া খোলা জমিটা পেরিয়ে যাওয়া। একইরকম দ্রুত আর নিঃশব্দ পদচারণার। জঙ্গলে ঢুকতেই একটা দৃশ্য চোখে পড়লো। এদিক ওদিক গাছের গায়ে বাঁধা ছোট ছোট লাল পতাকা। “জনানতনা সরকার কা ইলাকা। লিবারেটেড জোন মে ঘুঁষ গয়ে হামলোগ।” পাশে দাঁড়ানো যতীন। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া গলায়।
“তাহলে নদীর ওপারে কী ছিল?” প্রশ্ন করলো অভিরূপ।
“উসপার ভি হামলোগ কা কন্ট্রোল মে হ্যায়। লেকিন পুরি তরহা নেহি। পুলিশ, সি আর পি এফ অওর কোবরা ব্যাটেলিয়ান ঘুঁসতা রহেতা হায় উধার। রহ রহকে মুঠভেড় (এনকাউন্টার) হোতা হায় দোনো কে বিছ মে। এপারের তুলনায় ওপারে আমাদের স্কোয়াডগুলো অনেক বেশি খতরা নিয়ে কাজ করে।”
“আর এপারে? এপারে আসে না পুলিশ?”
অভিরূপের এহেন প্রশ্নে মুচকি হাসলো যতীন – “ইসপার আনেসে উনহে সোয়াগত জানানেকে লিয়ে পুরি বন্দোবস্ত হ্যায় … ওহ দেখিয়ে।” আঙুল তুলে হাত পাঁচেক দূরে একটা গাছের দিকে দেখালো যতীন। ওর তর্জনী লক্ষ্য করে চোখ গেল একটা মহুয়াগাছের গুঁড়িতে। কয়েকটা বড় বড় সাদা রঙের ছত্রাক গজিয়ে উঠেছে গুঁড়িটার গায়ে। তার পাশ ঘেঁষে বাঁধা সরু একটা ষ্টীলের তারের সামান্য অংশ বেড়িয়ে রয়েছে। বাকিটা ঝোপঝাড়ের ক্যামোফ্লাজের আড়ালে। না বলে দিলে ধরাই যেত না।
“বুবি ট্র্যাপ … মতলব মাইন। অ্যায়সে বহোত সারে বিছায়া হুয়া হায় পুরে জঙ্গল মে। আনজানে মে পাও লাগা তো গয়ে ভঁয়স পানি মে। সির্ফ গেরিলা লোগ অওর আদিবাসী ছোড়কে অওর কিসিকো পতা নেহি ইসকে বারেমে।”
আতংকে হিম হয়ে গেল অভিরূপ! তারে বাঁধা মৃত্যুপরোয়ানা! অ্যাতোটা সামনে। অসাবধানে একটু এদিক ওদিক গেলেই … এতো সেই কবে নিউএম্পায়ার লাইট হাউসে দেখা রোনাল্ড জফের ‘কিলিং ফিল্ডস’ আর অলিভার স্টোনের ‘প্ল্যাটুন’ –এর রেপ্লিকা, হুবহু। ছড়িয়ে রয়েছে এই পুরো আদিম অরন্যভূমি জুড়ে। কোন ফারাক নেই কম্বোডিয়া – ভিয়েতনামের পটভূমির সঙ্গে।
এই ঠাণ্ডার মধ্যেও কপালে গুঁড়ি গুঁড়ি ঘামের বিন্দু। দমচাপা ত্রাস আর আতঙ্কের দৈত্যটা বেশ কিছুক্ষণ সময় নিলো বুকের খাঁচা থেকে বেড়িয়ে যেতে। পরমুহূর্তেই যে প্রশ্নটা পাক মেরে উঠে এলো মনের মধ্যে সেটা হলো গেরিলা আর জনজাতিরা ছাড়া অন্যরাও তো রয়েছে এই জঙ্গলে। বন্যপ্রাণীরা, তারা কি?…” যতীনকে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই হাসলো ছেলেটা। সামান্য বিস্ময় মিশে রয়েছে সে হাসিতে। “হাম ভি যব পহেলা ইঁহা আয়ে থে, এহি সওয়াল মেরে মন মে ভি উঠা থা। আপ তো এক বরিষ্ঠ পত্রকার। নিয়মিত রূপসে ইয়ে সব ইলাকে কি খবর রাখতে হায় আপলোগ। আখবারপত্র, টেলিভিশন – হর এক মিডিয়া হালচাল মচা দেতে হায় আগর মাইন বিস্ফোট মে কোই পোলিসওয়ালে কি মওত হোনে সে … কখনও শুনেছেন মাইন ফেটে কোনও জানোয়ারের মওত হয়েছে? হামে লাগতা হায় কি হাথী, ভালু, হিরণ, চিতা, সাপ, পঞ্ছি … ইয়ে সব ভি হামহি লোগ কা তরহা জঙ্গল কে সন্তান হায়। উনহে ভি আচ্ছি তরহা সে মালুম হায় কি কাঁহা খতরা হায় অওর কাঁহা নহি।” একটানা কথাগুলো বলে চুপ করে রইলো যতীন। সকালে পাখিদের কলতান থেমে গেছে অনেকক্ষণ। খসখস … ঝরাপাতা মাড়িয়ে হেঁটে যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই আপাত নিস্তব্ধ এই অরণ্যে।
**********
“একটু চিন্তা হচ্ছে সেঁজুতি। অভিকে কনসাইনমেন্টটা দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। গতকাল সেই সকালে একবার ফোন করেছিল। বললো বাসে উঠে পড়েছে। তারপর থেকে আর কোন খবর নেই। এদিক থেকে যতবার ট্রাই করেছি, কোন সাড়াশব্দ নেই। বিলকুল বোবা মেরে আছে দু–দুটো নম্বর। যদিও জানি প্রায়র ইন্টিমেশন আছে, এক সপ্তাহের মধ্যে কোন খবর নাও আসতে পারে। তবুও …।” উদ্বিগ্ন শোনালো দিব্যেন্দু ব্যানার্জির গলা।
সম্পাদকের ঘর। আবহাওয়া বেশ থমথমে। দিব্যেন্দুকে ঘিরে চার পাঁচজন। সেঁজুতির পাশে বসা দীপায়ন। দীপায়ন বোস। ক্রাইম সেকশনটা দ্যাখে। ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো দিব্যেন্দুর দিকে। “দাদা, একবার অ্যাডমিনস্ট্রেশনের সঙ্গে কথা বললে হয় না? ওরা যদি কিছু …।”
“আচ্ছা দীপায়ন?” নিদারুন বিরক্তিমাখা চোখে দীপায়নের দিকে তাকালেন সম্পাদক। “তোমার কি আক্কেল বলে কোন বস্তু আছে? নাকি দুনিয়ার যত মাথামোটা অ্যান্টিসোশালদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে করতে ওদের মতই মাথামোটা হয়ে গ্যাছো। প্লীজ টক ইন সেন্স। একি কোন লোকাল ক্রিমিনাল গ্যাং পেয়েছো … বিপদে পড়ে যোগাযোগ করলাম আর অ্যাডমিন্সট্রেশন অ্যাকটিভ হলো। আরে বাবা রেড করিডর, ব্যাপারটা বোঝ? যাকে পি এম স্বয়ং বলছেন – ‘দ্য সিঙ্গল লার্জেস্ট ইন্টারনাল থ্রেট।’ আমাদের দেশের অলমোস্ট ওয়ান ফোর্থ ডিস্ট্রিকটস আর ইন দেয়ার কন্ট্রোল। অলমোস্ট অ্যান আনাদার কান্ট্রি … লাইক আ প্যারালাল গভর্নমেন্ট। মাচ মোর পাওয়ারফুল অ্যান্ড ডেডলিয়ার দ্যান তোমার ওই কি বলে গিয়ে আলফা – নাগা – মিজো, মনিপুরি মিলিট্যান্টস অ্যান্ড আদারস। আর তাছাড়া আমরা এরকম একটা এক্সক্লুসিভ অ্যান্ড কনফিডেনসিয়াল কনসাইনমেন্টের ব্যাপারে অ্যাডমিনস্ট্রেশনের হেল্প নিতেই বা যাবো কেন? স্পেশালি ইন সো আরলি স্টেজ। প্রেস নর্মস অ্যান্ড প্রেস্টিজ বলে একটা ব্যাপার আছে না নেই?” বিরক্তিতে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন দিব্যেন্দু। “এদিকে আবার অভির গার্লফ্রেন্ড ওই মেয়েটা … লেকচারার। শ্রীরূপা না কী যেন নাম …।”
“শ্রীতমা, দিব্যেন্দুদা।” ভুলটা শুধরে দিলো সেঁজুতি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, শ্রীতমা … তো শ্রীতমা ফোন করেছিল ঘন্টাখানেক আগে। অভির কোন খবর পেলাম কিনা। হার ভয়েস ওয়াজ র্যাদার অ্যাংশাস অ্যান্ড ওয়রিড। দিন সাতেকের মধ্যে ওর কোন ফোন বা মেসেজ নাও আসতে পারে সেটা মেয়েটাকে বলে গ্যাছে তো অভি? অবশ্য জানিয়ে গেলেও টেনশন তো থাকবেই। ইটস কোয়ায়েট লজিকাল অলসো।” বলে ফের চুপ করে রইলেন দিব্যেন্দু। সেঁজুতির পাশে বসা অর্জুন পিল্লাই। আদতে দক্ষিণ ভারতীয় কিন্তু তিন পুরুষ কলকাতায় লেকমার্কেটের বাসিন্দা। মাথাটা বরফের মত ঠাণ্ডা “ইন মাই ওপিনিয়ন দাদা, ইটস টু আরলিয়ার টু স্নিফ সামথিং রঙ অ্যাবাউট ইট। আই থিংক উই শুড ওয়েট ফর ওয়ান উইক। তারপর না হয় দেখা যাবে।” অর্জুনের দিকে তাকালেন দিব্যেন্দু। চোখে সামান্য দ্বিধা তবু মনে হলো প্রস্তাবটা মনে ধরেছে। “ওকে অর্জুন, আই থিংক ইউ আর রাইট … লেট’স সি হোয়াট হ্যাপেনস নেক্সট।’ চেয়ারের গদিতে নিজেকে ছেড়ে দিলেন দিব্যেন্দু ব্যানার্জি। বন্ধ চোখ। ভ্রু জোড়া তখনও কুঁচকে রয়েছে চিন্তায়। সেদিকে তাকিয়ে একে একে চেম্বার ছেড়ে বেড়িয়ে গেল সবাই।
**********
“ওহ যো পাহাড় দিখাই দে রহা। উসে ক্রস করকে উসপার যানা হায় হামলোগোঁকো।” দূরে একটা টিলাপাহাড়ের দিকে হাত তুলে দেখাচ্ছিল যতীন। একটু আগে কোশির নির্দেশে আধঘণ্টার বিশ্রাম পাওয়া গেছে। একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসা অভিরূপ। সামনে বসা যতীন। ওর কথা, কথার মাঝখানে দুচারটে ইংরিজী শব্দের ব্যবহার এবং চেহারায় এটা স্পষ্ট যে ও এই জঙ্গলের আদি বাসিন্দা নয়। আলাপচারিতার মাঝখানে কথাটা জিজ্ঞেসও করে ফেললো ওকে। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। কিন্তু ওর প্রশ্নের জবাবে যতীন যা বলেছিল তার চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু গোটা সাংবাদিক জীবনে তো বটেই, তার বাইরেও কোথাও শোনেনি অভিরূপ।
চলবে…
গত পর্বের লিঙ্ক – https://banglalive.com/bengali-novel-ketjel-pakhi-episode-5/
৪র্থ পর্বের লিঙ্ক – https://banglalive.com/bengali-novel-ketjel-pakhi-episode-4/
৩য় পর্বের লিঙ্ক – https://banglalive.com/bengali-novel-ketjel-pakhi-episode-3/
২য় পর্বের লিঙ্ক – https://banglalive.com/bengali-novel-ketjel-pakhi-episode-2/
১ম পর্বের লিঙ্ক – https://banglalive.com/bengali-novel-ketjel-pakhi/