টিলা পাহাড়ের চড়াই ভেঙ্গে উঠছিল ওরা চারজন। এবড়ো খেবড়ো অসমান রাস্তা বেয়ে। প্রায় চূড়ার কাছটায় পৌঁছে গেছে। এমন সময় হাত ত্রিশেক ওপরে একটা পাথুরে বাঁকের আড়াল থেকে ভেসে আসা হাল্কা শিস। “টুই, টুই” – পরপর দুটো। সেকেন্ড পাঁচেকের ব্যবধানে। জবাবে ‘টুই-ই-ই’, একটা মৃদু অথচ দীর্ঘ শিস দিলো কোশি। মিনিট তিনেক বাদে বাঁকের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলো একটা মুখ। কালো, ছিপছিপে চেহারা, নাকের নীচে পাতলা গোঁফ, চোখে চশমা। কাঁধে ঝোলানো ছোট বাটওয়ালা এ-কে ফরটি সেভেন। পিছনে জনা পনেরোর একটা স্কোয়াড। জলপাই ইউনিফর্মে সবাই। সশস্ত্র প্রত্যেকে। দলের সদস্য সংখ্যার প্রায় অর্ধেক মেয়ে। বেশিরভাগেরই চুল সেই কোশির মতো ছোট করে ছাঁটা। বয়েজ কাট। খেয়াল করলো অভিরূপ। চশমাধারী স্কোয়াড লিডারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলো যতীন – “কমরেড সুধাকর। স্কোয়াড লিডার।” অতঃপর ‘লাল সালাম’সহ পারস্পরিক পরিচিতি পর্ব। এসব মিটলে সুধাকরকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে নীচুগলায় কীসব বললো যতীন। শোনার পর অভিরূপের সামনে এগিয়ে এলো সুধাকর। এবং ওকে কিঞ্চিৎ বিস্মিত করে কথা বললো ইংরিজীতে। কথায় দক্ষিণী টান স্পষ্ট। “এখানে আসার পর অন্ততঃ এক সপ্তাহ কোনও মেসেজ অথবা ফোন করতে পারবেন না আপনি। ডিড’নট ইওর অর্গানাইজেশন ইনফরম ইউ অ্যাবাউট ইট?” হাল্কা বিরক্তির ছোঁয়া মিশে রয়েছে সে প্রশ্নে। এবার সামান্য বিব্রত অভিরূপ – “না। না, সেরকম কিছু নয়। আমার অফিস থেকে প্রায়র ইন্টিমেশন দিয়েই রাখা হয়েছিল। তাও যদি একবার …। অবশ্য সেটা ডিপেন্ড করছে অ্যাবসলিউটলি আপনাদের ডিসিশনের ওপর। আদারওয়াইজ দ্যাট কোয়েশ্চেন ডাজনট অ্যারাইজ।”
শোনার পর সামান্য নরম সুধাকর। চোরা বিরক্তির ছোঁয়া মিলিয়ে গেছে গলা থেকে। “সি কমরেড, এনি টাইপ অফ ফোন কল অর সেন্ডিং মেসেজ ইজ অ্যাবসলিউটলি রেস্ট্রিকটেড ফর আউটসাইডারস ওভার হিয়ার। স্টিল আপনি যখন রিকোয়েস্ট করছেন …।” বলতে বলতে পিছনদিকে এগিয়ে গেলো সুধাকর। অভিরূপের চোখে পড়লো লাইনের একদম পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলে। কাঁধে একটা পোর্টেবল ট্রান্সমিশন যন্ত্র। যুদ্ধের সিনেমায় যেমনটা দেখা যায়। মেশিনটার একধারে লাগানো একটা রিসিভার। দেখতে হুবহু পুরোন ল্যান্ডলাইনের রিসিভারের মতো। সেটা কানে তুলে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথা বললো সুধাকর। তারপর এগিয়ে এলো অভিরূপের কাছে। “লিসন কমরেড, এখান থেকে কোনমতেই আপনি ফোন বা মেসেজ কিছুই করতে পারবেন না। স্ট্রিক্ট অর্ডার ফ্রম হায়ার লেভেল। বাট দেয়ার ইজ অ্যানাদার অপশন। আপনি যদি মেসেজ টাইপ করে আমার হাতে সিমকার্ডটা তুলে দেন তাহলে বাই ইভনিং আপনি যেখানে খবরটা পাঠাতে চাইছেন সেখানে পৌঁছে যাবে। নাউ ইটস ইয়োর চয়েজ। বাট ইউ উইল গেট ব্যাক দিস সিমকার্ড ওনলি বিফোর ইয়োর ডিপার্চার ফ্রম হিয়ার। কিপ ইট ইন মাইন্ড।” কথাগুলো শোনার পর মিনিট খানেক চুপ করে ভাবলো অভিরূপ। প্রচুর তথ্য আর কনট্যাক্ট রয়েছে সিমকার্ড দুটোয়। এভাবে অজানা অচেনা কারো হাতে তুলে দেওয়াটা কি ঠিক হবে?
আর সুধাকরের কথাতেই পরিষ্কার এখান থেকে চলে যাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত ওগুলো ফেরত পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। পরমুহূর্তেই ঝাপটা মেরে ভাবনাটা সরিয়ে দিলো মন থেকে। খবর পাঠাতেই হবে। অন্ততঃ তিনটে এস এম এস। রিস্কটা নিতেই হবে। কিছু করার নেই। উত্তরের অপেক্ষায় থাকা সুধাকরের দিকে চোখ তুলে তাকালো অভিরূপ। “ও কে, আমি রাজি।” তারপর মেসেজ কাউন্টার ওপেন করে টাইপ করলো দ্রুতহাতে – “আই অ্যাম ফাইন। ডোন্ট ওয়ারি … উইল ট্রাই টু কনট্যাক্ট ইউ অ্যাজ আর্লিয়ার অ্যাজ পসিবল।” লেখা শেষ করে ফোনটা তুলে দিলো সুধাকরের হাতে। মেসেজের বয়ানটায় ভালো করে চোখ বুলিয়ে ফের মোবাইলটা অভিরূপের হাতে তুলে দিলো সুধাকর। “ব্যাটারিটা আর সিমকার্ডগুলো খুলে দিন। আর যাকে মেসেজ পাঠাচ্ছেন তার নম্বরটা একটা চিরকুটে আলাদা করে লিখে দেবেন। আর একটা ব্যাপার …” বলতে বলতে দলের এক সঙ্গীর দিকে এগিয়ে গেল সুধাকর। সামান্য কিছু কথা। সঙ্গীর পকেট থেকে বেড়িয়ে এলো একটা পুরু অ্যালুমুনিয়াম ফয়েল। সেটা নিয়ে ফিরে এলো সুধাকর। “ ভালো করে মুড়ে ফেলুন ফোনটাকে।” ম্যাক অ্যাড্রেস অর্থাৎ ট্র্যাক করবার সমস্ত সোর্সগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই।
অগত্যা পকেট হাতড়ে ছোট নোটখাতা আর পেনটা বের করে তাতে শ্রীতমা, মা আর দিব্যেন্দুদার নম্বর লিখে সিমকার্ড সমেত চিরকুটটা সুধাকরের দিকে এগিয়ে দিলো অভিরূপ। পরমুহূর্তেই মিষ্টি একটা হাসির ঝলক চশমার আড়ালে চোখজোড়ায়। “থ্যাঙ্কস কমরেড, থ্যাংক ইউ ফর বিলিভিং আস। চিন্তা নেই, খবর পৌঁছে যাবে … তাহলে আসি, লাল সালাম!”
ওদের যাওয়ার পথের দিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে রইলো চারজন। তারপর ফের চড়াই ভেঙে উঠতে লাগলো ওপরে।
সন্ধে নেমে এসেছে। দূর থেকেই চোখে পড়ছিল বেশ কয়েকটা ক্ষীণ আলোর ফুটকি। ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল আলোগুলো। মিনিট পনেরো চলার পর একটা ছোট গ্রাম। কুড়ি পঁচিশ ঘরের। গ্রামে ঢোকার মুখেই বিশাল একটা কেন্দুগাছ। তার তলায় দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন। হেঁটো ধুতি বা লুঙ্গি। চাদরে মোড়া উর্ধ্বাঙ্গ, প্রত্যেকে। দুজনের হাতে জ্বলন্ত মশাল। কোশিদের দেখামাত্র ডানহাত কাঁধের ওপরে – “লাল সালাম কমরেড!”
“লাল সালাম!”
“চলিয়ে কমরেড, আজ রাত ইধার হি ঠ্যাহেরনা হায়।” অভিরূপের দিকে তাকিয়ে হাসলো যতীন। তারপর পা চালিয়ে এগিয়ে গেলো সামনে। পিছনে পিছনে অভিরূপ।
বিকেল পাঁচটা। এর মধ্যেই চারপাশ প্রায় অন্ধকার। রাস্তা ধরে তিরবেগে ছুটছিল কালো হান্ড্রেড সি সি পুরনো মডেলের ইয়ামাহা মোটরবাইকটা। আরোহী বছর পঁচিশেকের একটা আদিবাসী ছেলে। মিনিট দশেক বাদে অপেক্ষাকৃত শ্লথ হয়ে এলো বাইকের গতি। সামনে রাস্তায় দু’ধার জুড়ে হাট বসেছে। ঝুড়ি, কুড়ুল, বেলচা, ছাগল, মুরগী, নুন, আনাজপাতি, মেটে কলসী আর দোনায় দোনায় তাড়ি, হাঁড়িয়া …। ভিড়, দোকানীর হাঁকডাক, সওদাপাতিতে ব্যস্ত হেটো মানুষ। রাস্তার একধার ঘেঁষে বাইকটা স্ট্যান্ড করালো ছেলেটা। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে পিছনটা খুলে সিমকার্ড বের করে নিলো। অন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলো আর একটা সিমকার্ড। মোবাইলে লাগিয়ে দু-একটা বোতাম টিপলো দ্রুতহাতে। ফের সিমকার্ডটা বের করে নিয়ে পুরোনটাকে যথাস্থানে লাগালো। সতর্ক দৃষ্টিতে একবার দেখে নিলো চারপাশ। তারপর বাইক স্টার্ট করে দ্রুত বেরিয়ে গেল এলাকা ছেড়ে।
‘কুঁক কুঁক’। মোবাইলে মেসেজ ঢোকার শব্দ। রুবি মোড়, সন্ধ্যেবেলা। ঘরফেরতা অফিসযাত্রীর ভিড়। পাশ কাটিয়ে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছিল পথচারীরা। একটা মেয়ে, কানে মোবাইল, চিৎকার করছে, হাঁফাচ্ছে প্রচণ্ড উত্তেজনায় – “মাসীমা, অভির মেসেজ এসেছে এইমাত্র! লিখেছে ভালো আছে। ও, আপনিও পেয়েছেন তাহলে … আ-আমি আসছি এক্ষুনি।”
“যাক, খবর তাহলে একটা পাওয়া গেল। যা টেনশন …।” এডিটরস চেম্বার। চেয়ারে বসা দিব্যেন্দু ব্যানার্জি। স্বগতোক্তি করলেন বিড়বিড় করে। স্বস্তির ছাপ স্পষ্ট চোখেমুখে। সেঁজুতিদের খবরটা জানানো দরকার এখনই। ইন্টারকমের রিসিভারটা তুলে নিলেন দিব্যেন্দু।
“দুবেজী, আভি আভি ও কলকাত্তাওয়ালে পত্রকার কা এক মেসেজ ট্র্যাক কিয়া হায় হামলোগোঁনে। কিষানপুর হাট কা নজদিক কোই জাগা … হাঁ হাঁ, আপকে পি এস টেরিটোরি মে পড়তা হায়। একবার আপনা ফোর্স কো ভেজিয়ে তো উস ইলাকা মে, ছানবিন কে লিয়ে।”
কোবরা হেড কোয়ার্টারের সামনে খোলা লন। মোবাইলে কথা বলতে বলতে লন জুড়ে পায়চারি করছিলেন রণজিৎ সিং রাঠোর। গলার স্বরে উত্তেজনা।
ফোনের উল্টোদিকে প্রহ্লাদ দুবে। লোকাল থানার আই সি। “জী স্যর, আভি ভেজ রহা হুঁ।” কথা বলা শেষ করে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন টেবিলে।
ঘণ্টাদেড়েক বাদে দুবেজীর ফোন। “স্যর, পুরা ইলাকা ছানবিন কিয়া। বহোত সারে আদমি কো পুছা। হামারে মুখবীর লোগোঁকো ভি পুছতাছ কিয়ে … এক পড়হালিখা টাইপ কা আদমি … আজনবী, ইলাকা মে দিখা গিয়া কা? লেকিন কিসিকো কুছ নেহি মালুম।”
“ঠিক হায় মিশ্রাজী। কড়ি নিগড়ানি (নজর) রাখিয়েগা ইলাকা পর। কোই ভি ইনফর্মেশন মিলে তো তুরন্ত বাতাইয়েগা। ওকে?… থ্যাঙ্ক ইউ।” রিসিভারটা টেবিলে নামিয়ে রেখে চোখ তুলে তাকালেন রাঠোর। “স্ট্রেঞ্জ! হামলোগকা হিসাব সে তো ওহ রিপোর্টার আবতক জঙ্গল মে হোনা চাহিয়ে। লেকিন ও কিষেনপুর মে আয়া ক্যায়সে?” চিন্তায় কুঁচকে যাওয়া ভ্রুজোড়া। বিস্ময়ের ছোঁয়া ব্যাটেলিয়য়ান কমান্ডান্টের কণ্ঠস্বরে।
টেবিলের উল্টোদিকে বসা সঞ্জীব পাঠক। ডেপুটি কমান্ডান্ট। বিভ্রান্ত সেও। নীচু গলায় বললো – “র্যাদার কনফিউজিঙ স্যর … আপ অর্ডার দেতে তো উধার কা রহনেওয়ালা দশ বিশকো উঠাকে লাতে রিম্যান্ড মে, ফির … ।”
“নো নো, পাঠক। ইটস টু আরলিয়ার টু টেক অল দোজ স্টেপস। নাউ লেটস ওয়াচ দ্য কনসিকোয়েন্সেস। তারপর না হয় একটা কিছু ভাবা যাবে।’’ ঘন ব্যাকব্রাশ চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন রাঠোর।
কাকভোরে ঘুম ভাঙলো অভিরূপের। ও কোথায়? ঘোরটা কাটতেই সময় লেগে গেল কয়েক মিনিট। মাথার ওপর মোটা ঘাসের চাল। চাদরটা সরিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসলো। একটা বাঁশের চাটাই। তার ওপরে মোটা করে খড় আর বাবুই ঘাস বেছানো। তার ওপর শুয়েছিল ও। মনে পড়লো রাতে যতীনও ওর সঙ্গে শুয়েছিল এই মাটির ঘরটায়। ঘরের মেঝে দেয়াল তকতকে পরিষ্কার। ভাত ভ্যাপসানো একটা টোকো গন্ধ ঘর জুড়ে। এক কোণে একটা মাটির মটকা, কালো রঙয়ের। বিছানা ছেড়ে বাইরে এলো অভিরূপ। সামনে একফালি উঠোন মতো নিকোনো জমি। চোখে পড়লো একটু দূরে কান্দু আর কোশি, একটা লম্বাটে পাথরের ওপর বসে একমনে বন্দুকের নল পরিষ্কার করছে ন্যাকড়া দিয়ে ঘষে ঘষে। পাশে তেল বা মোবিল জাতীয় কিছু রাখা। একটা বাটির মধ্যে। ‘যতীন কোথায়?’ হাতের ইশারায় প্রশ্ন করলো অভিরূপ। চোখ তুলে হাসলো কোশি – ‘আসছে’ বোঝালো ইশারায়। কথোপকথনের মাঝেই দূর থেকে “লাল সালাম কমরেড! বড়ি জলদী উঠ গয়ে, সুবহ সুবহ …।” হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে যতীন। পিছনে তিনটে ছেলেমেয়ে। একদম অল্পবয়েসী। চোদ্দ কি পনেরো হবে। মেয়ে দুটোর বুক থেকে কোমর অবধি পেঁচিয়ে বাঁধা টকটকে লাল রঙের একফালি কাপড়। ওই একই কাপড় ছেলেটার গলায় জড়ানো। দুজনের কাঁধে তিরধনুক। অন্যজনের কোমরে বড়সড় একটা কাটারি জাতীয় কিছু গোঁজা। সামনে এসেই প্রথা অনুযায়ী সালাম জানালো তিনজন। “কমরেড ডোরি, ফুলবন্তী আর জিতন।” আলাপ করিয়ে দিলো যতীন। “তিনজনই আমাদের চেতনা নাট্যমঞ্চের সদস্য। গাঁও গাঁও মে ঘুম ঘুম কে গানা গাকে, নাটক দিখাকে জাগরুক করতা জনতাকো। বাকি রাস্তাটুকু এরাই নিয়ে যাবে আপনাকে। তো, আলবিদা কমরেড। ফির মিলেঙ্গে। লাল সালাম।” ফের একবার সেই দুর্দান্ত সরল আর মিষ্টি হাসিটা হাসলো যতীন। সঙ্গে কান্দু আর কোশিও। তারপর সেই একইরকমভাবে রুটমার্চের তালে তালে পা ফেলে মিলিয়ে গেল জঙ্গলের আড়ালে। আর একবারও পিছন ফিরে না তাকিয়ে।
আবার সেই ক্লান্তিকর পথ হাঁটা। পায়ের নীচে মাড়িয়ে যাওয়া শুকনো ডালপালা আর ঝরাপাতার শব্দ। এবারের চলাটা আরও ক্লান্তিকর কারণ পথপ্রদর্শকের কেউই একবর্ণ হিন্দি জানে না। মাঝে মাঝে থামা, খাওয়া অথবা বিশ্রামের জন্য। ঠিক আগের বারের মতই। হঠাৎই শুকনো ডালপালা ধড়মড়িয়ে হাত দশেক দূর দিয়ে দৌড়ে চলে যাওয়া একটা নীলগাই, এছাড়া আর কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি পথে।
সন্ধ্যের মুখে আবার একটা গ্রাম। আগেরটার চেয়ে বড়। অন্তত পঞ্চাশ-ষাট ঘরের তো হবেই। গ্রামের একপ্রান্তে বড় একটা মাঠমতো খোলা জমি। একপ্রান্তে দুটো বাঁশের খোঁটায় বাঁধা একটা লাল রঙের শালু। শালুর গায়ে আঁকাবাঁকা দেবনাগরী হরফে কিছু লেখা। কিন্তু ভাষাটা দুর্বোধ্য। সামনে মাটিতে চ্যাটাই পেতে বসা শখানেক মানুষ। মেয়ে মরদ বাচ্চাকাচ্চা। প্রত্যেকে আদিবাসী। অনেকের হাতে উল্কি। মেয়েদের কানে মাকড়ি। হাসিঠাট্টা করছে, কথাবার্তা বলছে নিজেদের মধ্যে। দলটা পৌছোনো মাত্র একটা গুঞ্জন উঠলো ভিড়ের মধ্যে। বোঝা যাচ্ছিল দলটার অপেক্ষাতেই ছিলো সবাই। জিতনরা তিনজন গিয়ে দাঁড়ালো শালুর সামনে। সঙ্গে অভিরূপ। ওর সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিলো ফুলবন্তী। যার মধ্যে শুধু ‘কলকত্তা’ আর ‘কমরেড’ শব্দটা বোঝা গেল। প্রত্যুত্তরে হাত তুলে সমস্বরে একটা ‘হৌ হৌ’ জাতীয় কিছু বের হলো সবার মুখ থেকে। হাতের ইশারায় অভিরূপকে চ্যাটাইয়ের একপাশে বসতে বললো ডোরি। ইতিমধ্যে আরও দুটো ছেলেমেয়ে, ফুলবন্তী – জিতনদের বয়সী, একই ধরনের লাল কাপড় জড়ানো গায়ে, এসে দাঁড়িয়েছে শালুর সামনে। একজনের হাতে একটা ডফলি, অন্যজনের গলায় ঝোলানো মাদল। এবার দলটার মাঝখানে এসে দাঁড়ালো ডোরি। বলা শুরু করলো থেমে থেমে। যেন বর্ণনা দিচ্ছে কোন কিছুর। কথার সুরে অদ্ভুত একটা টান। অর্ধেক গান, অর্ধেক কথা। নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ। প্রতিটি বাক্যবন্ধের ফাঁকে ফাঁকে বেজে উঠছে ডফলি আর মাদল। কথা শুরু হওয়ার আগে ফের থেমে যাচ্ছে। কথার একবর্ণ বুঝতে না পারলেও কেমন যেন একটা ঘোর লেগে যাচ্ছিল অভিরূপের। কখন যে সেই আধা সুর আধা কথামালা ‘হুম হুঁহুঁ হুঁহুঁ হুঁহুঁ হুঁহুঁ হাঁ হাঁ’ জাতীয় একটানা একটা মাদকতাময় সাপখেলানো সুরে বদলে গেছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একটানা বেজে চলেছে ডফলি আর মাদল, বুঝতেই পারেনি অভিরূপ। সম্ভবত একটাই বাক্যবন্ধ। বারবার উচ্চারিত হচ্ছে গানে। শুধু শেষ বাক্যটা আলাদা। ‘বিরসা ভগবান … তিলকা মাঝি … সিদো কানহো … মাও …।’ স্পষ্ট বুঝতে পারছিল অভিরূপ। আচ্ছা এই জায়গাটা কী এই বিপুলা ধরিত্রীর কোথাও বিলঙ করে? যে পটভূমিতে রচিত হয়ে চলেছে এই জাদুবাস্তব দৃশ্যকলম, জিন-পাওয়া মানুষের মতো অভিরূপের দুটো চোখ। ঢুকে যাচ্ছে এই দৃশ্যকল্পের মধ্যে। গোল হয়ে একে ওপরের হাতে হাত রেখে ঘুরে ঘুরে নাচছে ফুলবন্তী, জিতন, ডোরি …। সঙ্গে সেই সাপখেলানো গানের সুর। উদ্দাম হয়ে ওঠা তালবাদ্য। সামনে বসে থাকা মানুষগুলো দুলতে শুরু করেছে মাদলের তালে তালে। একজন দুজন করে উঠে দাঁড়াচ্ছে ভিড়ের মধ্যে থেকে। দৌড়ে এসে যোগ দিচ্ছে নাচে। বড় হচ্ছে বৃত্তটা। আরও বড় … একটা বৃত্তকে ঘিরে আরেকটা। সেটাকে ঘিরে আরও অনেকগুলো … গোটা মাঠটা নাচছে। মোহগ্রস্থের মত ক্যামেরার ব্যাগটার দিকে হাত বাড়ালো অভিরূপ। জিতন, ডোরি, ফুলবন্তী … নাচতে নাচতেই হাত নাড়িয়ে ডাকছে। যোগ দিতে আহ্বান জানাচ্ছে নাচে। ‘ছবি তুলতে পারি?’ হাতের ইশারায় ক্যামেরাটা দেখিয়ে জানতে চাইলো অভিরূপ। হেসে ঘাড় নাড়লো ওরা। সম্মতি সে হাসিতে। পাতলা ছিপছিপে কুয়াশার আস্তরন, মশালের আলো আর টুকি দিয়ে যাওয়া আধো চাঁদের জোছনায় দুলছে খোলা মাঠ। আদিগন্ত চরাচর। জুম, অ্যাপারচার, ফোকাস, সব ঠিকঠাক করে দুচারটে স্ন্যাপ নেবার পরই মনে হলো, কী লাভ তুলে?
চলবে…
গত পর্বের লিঙ্ক – https://banglalive.com/bengali-novel-ketjel-pakhi-episode-7/
৬ পর্বের লিঙ্ক – https://banglalive.com/bengali-novel-ketjel-pakhi-episode-6/
৫ম পর্বের লিঙ্ক – https://banglalive.com/bengali-novel-ketjel-pakhi-episode-5/
৪র্থ পর্বের লিঙ্ক – https://banglalive.com/bengali-novel-ketjel-pakhi-episode-4/
৩য় পর্বের লিঙ্ক – https://banglalive.com/bengali-novel-ketjel-pakhi-episode-3/
২য় পর্বের লিঙ্ক – https://banglalive.com/bengali-novel-ketjel-pakhi-episode-2/
১ম পর্বের লিঙ্ক – https://banglalive.com/bengali-novel-ketjel-pakhi/