আজ রবিবার।একটু আগেও ছিল ঝলমলে শীতের সকাল,দুম করে নীল আকাশে কেউ মাখিয়ে দিল ভুসো কালি ।কেউটে সাপের মত মেঘ ফণা তুলে ঘুরতে লাগল।
এমন সকালে রমা নিবাসের বাইরের বারান্দায় কুকুর ঘুমিয়ে ছিল। বিড়াল ছুটে এসে তার কানের কাছে মিনমিন করে বলল,শুনছ কুকুর, আজ এ বাড়িতে আবার ঝগড়াঝাঁটি শুরু হবে মনে হচ্ছে!একটু আগে ঝনঝন শব্দে বাসনকোসন পড়ার শব্দ পেলাম।
কুকুর ঘুম জড়ানো গলায় উত্তর দিল,সারাদিন বকবক করো কেন?একটু ঘুমবো তার মধ্যে রাজ্যের চেঁচামেচি।
—ওমা, আমি কখন চেঁচালাম! ফিসফিস করেই তো খবরটা দিলাম।আমি খবর না দিলে জানতেই পারতে না, আকাশের অবস্থা ভাল না।সকাল হয়েছিল আবার রাত হয়ে গেছে।বুঝলে!
— কে তোমায় দিতে বলেছে খবর!তোমার সংগে বন্ধুত্ব করাই ভুল হয়েছে।
বিড়াল গাল ফুলিয়ে দুটো বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি আজকাল যা লেকচার ঝাড়ছ তাতে মুখ খুলতে ভয় হয়। এই বাড়িতে আজ ঝগড়া হবে কিনা জানতে চাইতেই এত কথা শুনিয়ে দিলে! শুনে রাখ, আজ ঝগড়া শুরু হলে আমি অন্য বাড়ি চলে যাব।প্রতিদিন এসব আমার সহ্য হয় না। তুমি কুকুর তাই তোমার কানে না লাগতে পারে, আমার এসব পোষায় না। যদি থাকি মান–সম্মানের সংগে থাকব।
কুকুর চোখ বড়বড় করে বলল, চোরের মায়ের বড় গলা।
— তুমি একটা ছোটলোক।
— সেইতো! রাত জেগে পাহারা দিয়ে আমি হলাম ছোটলোক।
— দেখা আছে কত পাহারা দাও।কাল রাতেও…
— প্লিজ,কথাটা গোপন রাখলেই ভাল হয়।সব কথা পাঁচকান করতে নেই। খুব ভয় হয় যা পেটপাতলা তুমি।
বিড়াল ফ্যাচফ্যাচ করে সবে হাসতে যাবে এমন সময় ঝনঝন করে আবার বাসনপত্র পড়ার শব্দ হল।মুখ ফসকে সে বলেই ফেলল, এই শুরু হল।
—আমি আজই বাবার বাড়ি চলে যাব।এই সংসারে মানুষ থাকে! একটা অপদার্থ লোক জুটেছে আমার কপালে!
— বাজে কথা বলবে না। একদম বাজে ককথা বলবে না।যেতে হলে চলে যাও। প্রতিদিন এক কথা বলে ঘ্যানরঘ্যানর কোর না।
— আমি ঘ্যানরঘ্যানর করি।
— অবশ্যই করো।
— আজ আমি আর কারুর কথা শুনব না। আমি চলে যাব।যেখানে খুশি চলে যাব।
—- যেখানে খুশি যাওয়ার কথা কিন্তু ছিল না। তুমি যাবে তোমার বাবার বাড়ি। যেখানে দুটো দিন পার হলেই তোমার বড় বৌদি গতবারের মত বলবে, এই যে নীতা ও বাড়ি থেকে পার্থ কবে আসবে তোমায় নিতে! মনে আছে সেসব।
নীতা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। পার্থ বুঝল পরিস্থিতি ক্রমশ ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। এমন সচারাচর হয় না। সে চাপা গলায় বলল,এই মাত্র আমাদের বাড়িওয়ালার দোতালার জানালা বন্ধ হল, নিশ্চয় আড়ি পেতে শুনছিলেন মিত্তিরবাবু।এর পর কান্নাকাটি শুনলে হাঁক দেবেন,বৌমা, সামনে বুঁচির মাধ্যমিক, ও আজ একটু পড়তে বসেছে। ওর পড়াটা নষ্ট কোর না।
নীতা চোখ বড়বড় করে উত্তর দিল, ভাড়াটিয়া বলে একটু কাঁদতেও পারব না।শোন,ওনার নাতনির সামনে মাধ্যমিক বলে আমি পা টিপেটিপে হাঁটব! উনি যে যখন তখন বিটকেল মার্কা কাশতে থাকেন সেসব নিয়ে আমরা কখনও কিছু বলেছি?
— না, বলিনি। কারণ সেটা করে তিনি আমাদের থামতে বলেন।তুমি সংকেত বোঝনা বলেই বকবক করেই যাও।
— আমি সংকেত বুঝি না!ঠিক বলেছ, আমি সত্যিই বুঝি না। বুঝলে বাড়ি ছেড়ে তোমার মত মানুষের সংগে সংসার করতে আসতাম না। কখনও মনে হয় যে দিকে চোখ যায় চলে যাব।
বাড়িওয়ালা কান পেতে আমাদের সব কথা শুনবেন আর সব জেনে একজন বলবে চুপ করে থাকতে!
— বুচির পড়াটা দেখবে না? ওর সামনে মাধ্যমিক।
—- রাখো তোমার বুচির পড়া! নিজের কথা বলার মত পরিবেশ যেখানে নেই সেখানে আমি থাকব না।
পার্থ আর কথা বাড়াল না। অবস্থা আবার খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।
বিড়ালের কাছে ঘেষে এল কুকুর,ভয়ে ভয়ে বলল, বৌটা সত্যি সত্যি চলে যাবে না তো!
বিড়াল ফ্যাচ করে একটু হেসে বলল, পৃথিবী গোল।যেখানেই যাক ঠিক এখানেই ফিরে আসবে।আমাদের মত।
—- ঠিক বলেছ বিড়াল।এবার বন্যার পরে ভাবলাম আর বুঝি দেখা হবে না তোমার সাথে।
— মনে রাখবে কুকুর,আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলন আছে তা হল তুমি যদি কাউকে নিয়ে অনেক অনেক চিন্তা কর, তাহলে অবশ্যই তার সাথে আবার দেখা হবে।
—- তাই তো দেখলাম। শুধু এই ঝগড়াবিবাদ ভাল লাগে না।
—- তা বললে চলবে কেন কুকুর! যেসব জিনিসের আকার আছে তা হারিয়ে যায়, ঝগড়ার আকার নেই তাই সে অনন্তকাল থেকে যাবে।
কুকুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,আজ কিন্ত ঝগড়াটা তেমন জমল না।অন্যদিনের মত বাড়িওয়ালা বুড়োটা নেমে এসে বুঁচির পড়াশুনা নিয়ে মস্ত লেকচার দিতে পারল না।
বিড়াল ফ্যাচ ফ্যাচ শব্দ করে একটুক্ষণ হাসার পর বলল, ধ্যুস, বুচি ছাই পড়ে।কাল বিকেলে দেখলাম, পড়তে বসে লাভ লেটার লিখছিল।আমি গড়গড় করে বলার চেষ্টা করেছিলাম, এই ছুড়ি কী সর্বনেশে কান্ডে জড়াচ্ছিস! সে ছুড়ি আমায় বুঝলই না,উলটে তার স্কেল উঁচিয়ে আমায় তাড়িয়ে দিল।আর একদিন বড়পার্কে বুঁচিকে দেখি একটা পুঁচকে ছেলের সংগে… সবটা বলা যাবে না,বলতে লজ্জা পাচ্ছি, বুঝেছ তো কুকুর?
—সে আবার বুঝব না!এবার যাও দেখি।আমি একটু শান্তিতে ঘুম দিই। সকালটা এমনিতেই মাটি হয়ে গেছে। জেগে থাকলে বড্ড খিদে পায়।
দুই
দুপুরে পার্থ ফিরল না। ফিরল রাতে।চারভাঁজ করা বাজারের ব্যাগটা আগের মতই হাতে ধরা।যেন সে বাজারে নয় অন্যকোনো জরুরি কাজে গিয়েছিল।নীতা তাকে দেখে একটুও রাগ দেখাল না।যেন কিছুই হয়নি এমন স্বাভাবিক গলায় বলল, তাড়াতাড়ি স্নান সেরে এস,আমি ততক্ষণে খিচুড়িটা গরম করি।
পার্থ অবাক হয়ে কিছুক্ষণ নীতার দিকে তাকিয়ে থাকল।
রাতে আলো নিভিয়ে পার্থর চুলে বিলি কাটতে কাটতে নীতা বলল,একজন আসছে আমাদের মাঝে, বুঝেছ?
পার্থ আনন্দে কেঁপে উঠল।মুহূর্তের মধ্যে তার আনন্দে থাবা বসাল ভয়।যেন গোপন করে রাখা কথা গুলো সব ফাঁস হয়ে যাবে। ভয়টা বারবার যেন তার কানের কাছে ফিসফিস করতে লাগল, প্রেসের অবস্থা ভাল না। সেখানেও তেমন কাজ নেই।
সুধাময়ী প্রিন্টিং প্রেসের সে একজন কর্মচারী। মালিক পরেশ দত্ত দিন কয়েক আগেই বলেছে, আর ক‘মাস এভাবে লোকসান করতে করতে প্রেস চালু রাখতে পারব জানি না। আমি চাই পার্থ, একেবারে ঝাঁপ বন্ধ করার আগে ভাল একটা কাজ তুমি খুঁজে নাও।
টেনেটুনে কোনমতে সে সংসার চালিয়ে নিচ্ছে।যদিও এটাকে ঠিক চলা বলে না। এসব ভাবতে গিয়েই পার্থর চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
নীতা বলল,ভাবছি ঐ নার্সারী স্কুলে কাল থেকে আর পড়াতে যাব না।এ সময় এতটা হাঁটা কি ঠিক হবে?
পার্থ চুপ করে থাকল।
নীতা আবার বলল, দুটো নাম বেছেছি। একটা মেয়ের আর একটা ছেলের। সম্পূর্না আর পার্থিব।দারুণ না নাম দুটো?
পার্থ আগের মতই থম মেরে আছে। সে বলতে চাইল,এত তাড়াতাড়ি বাচ্চাকাচ্চা… বলতে পারল না।ক্ষুদে ক্ষুদে দুটো হাত,লাল টুকটুকে দশটা আঙুল তার দিকে টালমাটাল পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল।
—- চুপ করে গেলে যে, নাম গুলো পছন্দ হল না।
নিঃশব্দে চোখ মুছল পার্থ।মুখে বলল, নাম দুটো দারুণ। এত সুন্দর নাম পেলে কোথায়!
নীতা হাসতে লাগল।
জানলার পাশে শুয়ে এসব শুনছিল বিড়াল। এসব কথা এক্ষুণি কুকুরকে না জানালে তার আর ঘুম আসবে না বলেই সে ছুটে গেল। সব শুনে কুকুর বলল, ছেলেটি কিছুই বলল না।
— তাই তো চমকে গেছি।এমন একটা খবর পেয়েও কেমন করে চুপ করে থাকে!
— আমিও সেটাই বুঝছি না।কান্না আর চাপা কথাবার্তা ভেসে আসছে।শুনতে পাচ্ছ?
— হুম, পাচ্ছি।
— চলো, বিষয়টা শুনে আসি….
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার মেখে যেন বাড়িটা লুকিয়ে পড়েছে। শুধু একটানা কান্না আর চাপা কথাবার্তা অন্ধকারের দেয়ালে এসে ধাক্কা দিচ্ছে।
কুকুর আর বিড়াল এসে দাঁড়াল ওদের ঘরের কাছাকাছি।নীতার গলা শোনা গেল,তুমি কেমন করে এসব বলতে পারলে?জেনে রাখো, মরে যাব তবু আমি কিছুতেই অমন কিছু করব না। কিছুতেই না।আমি ওকে আনবই।
—- পাগলামি কোর না।টেনশন করবে বলে তোমায় আগে বলিনি,প্রেসের অবস্থা ভাল নয়।এই আছে এই নেই অবস্থা। এমন অবুঝ হলে সংসার চলবে কি করে?
—-আমি মরে গেলেও তোমার কথা শুনব না। কখনই না।
নীতা কাঁদতে লাগল। পার্থর গলা শোনা যাচ্ছে না।
কুকুর লেজ নাচাতে নাচাতে ফিসফিস করে বলল, বিষয়টা সিরিয়াস মনে হচ্ছে?
— হুম।
— এবার কি হবে?
— জানি না।
—মেয়েটা বড্ড অবুঝ।
—এমন হয়।প্রতিবার মা হবার আগে এমন অবুঝ হয়ে উঠি। এটা আসলে গর্ব। তুমি বোঝনা?
—- বুঝি,তা….তোমার তো দিন চলে এল বিড়াল।এখন তো খুব খিদে পাবার কথা ।ভাল বাড়ি দেখে চলে যাচ্ছ না কেন?
—– তুমিও তো কোথাও যাওনি সেসময়,এবাড়িতেই পড়ে ছিলে।
কুকুর একটু হাসল,এই বাড়িটা ছেড়ে কোথাও যেতে পারিনা। মনে হয় আমার গতবার, তার আগের বার, তার আগের বারের হারানো ছেলে মেয়েরা ফিরে আসবে।গত বার দুটো গাড়ি চাপা পড়ল,দুটোকে কে যে কোথায় নিয়ে গেল।তবু একটু একটু করে এবার যখন পেট উঁচু হচ্ছে আর মনের ভেতরে আনন্দ যেন লাফাচ্ছে।
বিড়াল মিউমিউ করে বলল, অতীত কে হেলাফেলা করা যায় না কুকুর।অতীত অমর।আমরা না।শুধু মাঝখানের মা হতে যাওয়া দিনগুলো গর্বের।ওই বৌটারও। জেনে রাখ এভাবেই আমরা বেঁচে থাকি।কেউ কোথাও যেতে পারি না। সব্বাই সব্বার খাঁচাতে ফিরে এসে শান্তি পাই।
কুকুর উদাস গলায় বলল, আর খিদের কথা বললে না।
বিড়াল আকাশের দিকে তাকাল, দ্যাখো এক্কেবারে আমাদের মত একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে।
আকাশে এখন বাচ্চাদের বাতিল, তোবড়ানো,নোংরা ফুটবলের মত চাঁদ স্থির হয়ে আছে।যেন তার মন খারাপ। কুকুর আর বেড়াল ঝাপসা চোখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকল।
One Response
ami apnader amar likha kichu golpo pathate chai