কলকাতায় ব্যবসার শুরুর লগ্নটা মোটেই সুখকর হয়নি বিদেশি বণিকদের কাছে। এখানে তখন লুঠতরাজ বেশ। মাঝে মধ্যেই হামলা চালায় দস্যুরা। খুন, জখম করে আবার পালিয়ে যায়। জব চার্নক কলকাতায় পা রেখেই তো থ’। ব্যবসার যাবতীয় রসদ মজুত, অথচ পরিবেশ নেই।
আসলে কলকাতায় তখন বর্গিদের বেশ উৎপাত। এই উৎপাত থেকে বাঁচতে একটা পরিখা কাটা হয়। অনেকেই জানেন, এই পরিখার নাম ছিল সার্কুলার ক্যানেল। আর সেই পরিখা যখন বুজিয়ে দিয়ে রাস্তা তৈরি হয়, সেই
রাস্তার নাম হয় সার্কুলার রোড। যাইহোক, বাগবাজার থেকে শুরু হয়ে সেই পরিখা গিয়ে মিশেছিল আদিগঙ্গায়।আবার বৈঠকখানা, মানে আজকের শিয়ালদহ অঞ্চল থেকে একটি খাল বেরিয়ে, আজকের গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, হেস্টিংস স্ট্রিট হয়ে মূল গঙ্গার সঙ্গে মিশেছিল। জব চার্নক বৈঠকখানায় একটি উপবন্দর তৈরি করেন। সেই উপবন্দরেই ভিড়ত প্রচুর নৌকা। এই উপবন্দর তৈরি হওয়ায় বর্গিদের যেন আরও সুবিধা হয়ে
গেল। তাঁরা অনায়াসেই লুঠপাট চালাতে পারত।
বর্গিদের অত্যাচারে কার্যত বেঁকে বসলেন বণিকরা। যে কোনও বণিকের পক্ষেই এভাবে ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তাঁরা ধীরে ধীরে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে শুরু করলেন। কিন্তু এতে অশনি সঙ্কেত দেখতে পেলেন জব চার্নক। জমিদার এবং সুবাদারদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে একটা উপায় বের করলেন তিনি। কারণ
জমিদার এবং সুবেদাররাও এই বর্গিদের অত্যাচারে কার্যত দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন। সে কারণেই তাঁরা বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের হাত। বর্গিদের ঠেকাতে জব চার্নক তৈরি করলেন রক্ষীদল।
প্রাণতোষ ঘটক লিখছেন, ‘জব চার্নকের আমলে কলকাতায় পথিমধ্যে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ফাঁসী দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। হয়তো মানুষের মনে অন্যায়কার্য্য না করার প্রভাব বিস্তারের জন্যই এই নিয়ম প্রচলিত ছিল। সে যুগে শাস্তিও ছিল অত্যন্ত কঠোর । সামান্য চুরির জন্য হাত পুড়িয়ে দেওয়া, সাধারণের সম্মুখে বেত্রাঘাত করা, তুড়ুম ঠোকা এবং হত্যা বা লুটের জন্য দীপান্তর বাস বা ফাঁসীর সঙ্গে সঙ্গে মৃতদেহ লোহার শিকলে বেঁধে পথের ধারে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া হামেশাই চ’লতো।’
চার্নকের রক্ষীদল টহল শুরু করল পরিখা পথে। পর্তুগীজ দস্যুরাও এসব দেখে বেশ গুটিয়ে গেল। অত্যাচার অবশ্য জারি থাকল। এরকমভাবেই চলছিল, বণিকরাও ফিরল ব্যবসা নিয়ে। কিন্তু এর মধ্যেই একদিন এক দস্যু সর্দারকে পাকড়াও করল চার্নকবাহিনী। এই দস্যু সর্দার ছিল ভয়ঙ্কর। লুঠপাট থেকে খুন-জখম, কোনও তাঁর বিরুদ্ধে সব রকমের অভিযোগ। চার্নকের নির্দেশে তাঁকে বেত্রাঘাত করে অস্থায়ী কারাগারে বন্ধ করে রাখা হল। কিন্তু দুঁদে ক্রিমিনাল বলে কথা, সে কি আর কারাগারে থাকবে ! তাই কারাগার থেকে পালিয়ে গেল সে। রক্ষীদল আর খোঁজ পেল না তাঁর। লোকে ভাবল, আপদ গেছে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই সে আবার উদয় হল। চার্নক এক বঙ্গতনয়ার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। সেই মহিলার সঙ্গে একদিন রাতে ঘুমিয়ে আছেন চার্নক, এমন সময় সেই দস্যু সকলের নজর এড়িয়ে ঢুকে পড়ল সে ঘরে। ধারালো অস্ত্রের কোপে শেষ করতে গেল চার্নককে। চার্নকের সঙ্গে ধস্তাধস্তি বেঁধে গেল তার। কিন্তু চার্নকের স্ত্রী বিপদ ঘণ্টি বাজিয়ে দিতেই ছুটে এলেন প্রহরীরা। পাকড়াও করলেন দস্যুকে।
এবার আর ছাড়াছাড়ি নয়। লঘুদণ্ড দেওয়ার পরও যার শিক্ষা হয়নি, তাকে তো গুরুদণ্ড দিতেই হয়—সম্ভবত এই ভেবেই চার্নক তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দিলেন । বর্তমানে রেড ক্রস প্লেস অর্থাৎ রাজভবনের উত্তর গেটের পেট চিরে ওল্ড কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের মাঝামাঝি একটি জায়গায় তৈরি হল ফাঁসি মঞ্চ। সেখানে ফাঁসিতে চড়ানো হল ওই দস্যুকে । সেই যে ফাঁসি কাঠ তৈরি হল, এরপর থেকে কোনও ছোটখাটো অপরাধেও ফাঁসিতে লটকিয়ে দিতেন জব চার্নক। সেই থেকেই এই রাস্তার নাম হয়ে গেল ফাঁসি লেন।
তবে ইংরেজরা তো ফাঁসি শব্দটি উচ্চারণ করতে পারতেন না, তাঁরা বলতেন ‘fansy’। কালক্রমে সেই ‘fancy’ হয়ে গেল ‘fancy’-তে। রাস্তার ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ে উল্লেখ করে গিয়েছেন পুরনো কলকাতার অনেক সাহেব । তাঁরা লিখেছেন, রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছিল খাল (যে খালটি ভাগীরথী থেকে বৈঠকখানায় এসে পৌঁছেছিল)। একটি গাছের ধারে তৈরি হয় ফাঁসি মঞ্চ। সেখানে ফাঁসি দেওযার পর গাছে ঝুলিয়ে রাখা হত মৃতদেহ, যাতে সকলের শিক্ষা হয়। তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে পেরিয়ে যাওয়া ফাঁসি গলি আর ফ্যান্সি লেন। কানাগলিটির সামনে দাঁড়িয়ে অনেক বাঙালিই হয়ত ভাবেন, ফ্যান্সি এখানে কোথায়! হয়ত ফ্যান্সি লেন হাসে। হাসে ফাঁসিকাঠে প্রাণ যাওয়া অতৃপ্ত আত্মারা।