জুতা আবিষ্কার সত্যিই কবে হয়েছিল, সে সম্পর্কে একমাত্র রবি ঠাকুর ছাড়া আর কেউ আলোকপাত করতে পারেননি। হবুচন্দ্র রাজা আর গবুচন্দ্র মন্ত্রীর গল্প তো আমরা সকলেই জানি। যা জানি না, তা হল হবুচন্দ্রের শাসনকাল। তাহলে হয়ত বোঝা যেত, জুতা ঠিক কবে পায়ে পড়েছিল মানুষ। কারণ দ্বাপর ও ত্রেতা যুগেও
‘মলিন ধূলা লাগিবে কেন পায়/ ধরণীমাঝে চরণ-ফেলা মাত্র?’-এ কথা ভেবেই ‘নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে’ বলে লোকজন জুতো বা চটি পরতেন।
এ কথা বলা যেতে পারে, কলকাতাও আদি-অনন্তকাল ধরে জুতো এবং চটি পরে এসেছে। তাই মুচিদের একটা অংশ করেছিল সমাজ। যদিও মুচিরা ছিলেন সমাজের একদম নিম্ন অংশে। আর ইংরেজ আমলে! চটি-জুতো
তৈরি ছাড়াও অন্যান্য কাজও মুচিদেরই করতে হতো। যেমন সরকারি ঘোষণার জন্য যে ঢেঁড়া পেটানো হতো, সেই ঢেঁড়ার চামড়া তৈরি করা, কেরানিদের খাতা গুছিয়ে রাখার জন্য চামড়া দিয়ে খাতা বাঁধানো, সারিপাড়ায় আগুন জ্বালিয়ে রাখতে চামড়ার জাঁতা বা হাপড় তৈরি করা ইত্যাদি।
কিন্তু এই চামড়া কোথা থেকে আসবে ? কলকাতা শহরের বহর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি মুচিবাজার গড়ে উঠেছিল । উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সেই মুচিবাজার ভালই জমজমাট। তার মানে এটা ধরে নেওয়াই যায় যে অনেক কাল আগে থেকেই এই মুচিবাজার বসতে শুরু করেছে। এই মুচি বাজারে মুচিদের প্রয়োজনীয় দ্রব্য মিলত বলেই মনে করা হয়। এর ঠিক এক বছর পর উত্তর শহরতলির উল্টোডাঙায় গড়ে ওঠে একটি মুচিবাজার। ১৯১৫ সালে। এই বাজারের প্রতিষ্ঠার গল্পই আজ বরং বলা যাক—
কৃষ্ণমোহন দাস ছিলেন বর্ধমানের বামন আড়ার রতনপুরের মানুষ। পায়ে হেঁটে তিনি কলকাতা চলে আসেন। সিমলার কাঁসারিপাড়ায় চামরা দিয়ে যে জাঁতা বা হাপর তৈরি হতো, তারই কাজ করতেন তিনি। নিজের ব্যবসা। কিন্তু বেশিকাল তিনি বাঁচেননি। খুব অল্প বয়সেই তাঁর মৃত্যু হয়। কৃষ্ণমোহনের স্ত্রী চার ছেলেকে নিয়ে ফিরে যান তাঁর বাপের বাড়ি বীরভূমে। কৃষ্ণমোহনের চার ছেলে বড় হন, ছোটখাটো কাজকর্ম শুরু করেন। তখন কলকাতা বেশ জমজমাট। গ্রামে থেকে কিছু হবে না, এই ভেবেই তাঁরা চলে আসেন কলকাতায়। সালটা ১৮৫৬। গোয়াবাগান হয় তাঁদের ঠিকানা।
যখন ফের কলকাতায় চলে আসেন কৃষ্ণমোহনের ছেলেরা, তখন মেজ ছেলে মাধবচন্দ্রের ছেলে মানে কৃষ্ণমোহনের নাতির বয়স চোদ্দ বছর। দীননাথ দাস। খুব কষ্ট করেই চলছিল তার বড় হয়ে ওঠা। সন্তানের ভাগ্যে তাঁদের সংসারের ভাগ্য ফিরবে বলে আশাবাদী ছিল গোটা পরিবার। ঈশ্বর মুখ তুলে চান, একদিন সত্যি সত্যিই ভাগ্য ফেরে দাস পরিবারের। ১৮৬৫ সাল, বাংলার ১২৭২ সনের আশ্বিন মাসে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি হয়, যা সকলের কাছে পরিচিত আশ্বিনের ঝড় নামে। সে সময় একটি চামড়া ভর্তি জাহাজ ডুবে যায় গঙ্গায়। দীননাথ খুব অল্প দামে সেই ভিজে চামড়া কিনে নেন। ব্যস, লক্ষ্মীদেবী প্রসন্ন হয়ে দীননাথের ঘরে ঢুকে পড়েন ।
ভিজে চামড়া শুকিয়ে বিক্রি করে কৃষ্ণবাগান, উল্টোডাঙা, ধর্মতলা সহ বেশ কয়েকটি জায়গায় সম্পত্তি করে তোলেন দীননাথ । কলকাতায় সে সময় কোনও ট্যানারি ছিল না। বিদেশ থেকে চামড়া আসত। আর সেই চামড়া অনেক দাম দিয়েই কিনতে হতো মুচিদের। দীননাথ প্রথম ট্যানারি তৈরি করেন। একটা নয়, বেশ কয়েকটি। সে সময় গরু, মহিষের মৃতদেহ ফেলার রীতি ছিল গঙ্গায়। দূষণ বাড়ছে, এই কথা বলে ইংরেজদের থেকে গঙ্গা পরিষ্কার করার ইজারা নেন দীননাথ। গঙ্গা থেকে পশুদের দেহ তুলে এনে সেই চামড়া পরিষ্কার করতে থাকেন তিনি । এতে প্রচুর লাভ হয় তাঁর । কলকাতায় অন্যতম ধনী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন দীননাথ। মুচি দীননাথ হন বাবু দীননাথ দাস। উল্টোডাঙায় একটি বাজার চালু করেন দীননাথ। কিন্তু বাবু দীননাথ তো জাতে মুচি, তাই তাঁর বাজারে কেউ পা দিলেন না । বাজারকে জনপ্রিয় করার জন্য বারোয়ারি পুজো শুরু করেন দীননাথ। কিন্তু তাতেও লাভ হল না।
যে ব্রাহ্মণরা দীননাথের থেকে সময়-অসময়ে টাকা ধার নিতেন, তাঁরাও পা রাখলেন না দীননাথের বাজারে । বাজার এলাকায় এক মন্দির তৈরি করেন দীননাথ। এর জন্য তাঁকে ব্রাহ্মণদের কথা মেনে বিপুল অর্থব্যয় করতে
হয়। তাতেও লোক হল না মুচিবাজারে। শেষকালে মুচিবাজারের নাম ‘রাধাগোবিন্দ জীউয়ের নতুন বাজার’ নামে প্রসিদ্ধ করতে চান তিনি। কিন্তু ঈশ্বরের নামে বাজারের নামকরণ করেও সমাজের মন বদলাতে পারেননি দীননাথ। মুচিবাজার নামেই এই বাজার বিখ্যাত হয়। কলকাতার চটি জুতোর যখন প্রসঙ্গ উঠলই, তখন একটি কথা না উল্লেখ করলে হয়ত এই লেখা সম্পূর্ণ হবে না। তা হল তালতলার চটি। কলকাতার তালতলা অঞ্চলে মুচিরা খাসা চটি বানাতেন। আর সেই চটি ছিল মার্জিত সাজের একটি অঙ্গ । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও সেই চটি পরতেন। তবে সাহেবদের এসব পছন্দ ছিল না। কারণ এই চটি পরার জন্য বিদ্যাসাগরকে একবার ভারতীয় জাদুঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।