ফ্যান্টাস্টিক ফোর, স্পাইডারম্যান, অ্যাভেঞ্জারস, এক্স ম্যান, ব্ল্যাক প্যান্থার, আয়রন ম্যান, ডেয়ারডেভিল, হাল্ক, থর—এইসব জনপ্রিয় নামগুলি পেরিয়ে আসা শতাব্দীর ষাট, সত্তর ও আশির দশকে কালি ও কলমে ফুটে ওঠা কমিক জগতের চরিত্র। বলা ভাল সুপারহিরো। এ রকম হিরো এবং সুপারহিরোর নামের তালিকা আরও লম্বা। তবে শুধু হিরো নয়, অনেক ভিলেন চরিত্রও আছে। বহুকাল ধরে ওদের কাণ্ডকারখানায় আলোকিত হয়েছে
শৈশব।
একটা পর্যায়ে শৈশবের গণ্ডি ছাড়িয়ে কমিকস পৌঁছে গিয়েছিল আরও খানিক দূর। শুধু তো শিশুদের মনোজগৎ নয় সব বয়সের মানুষের মধ্যে এক ধরনের আলোড়ন জাগিয়েছিল কমিকস। আর হৈ হৈ করে তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে গিয়েছিল সর্বত্র। কমিকের সুপারহিরোরা এখন আর দৈনিকে কিংবা ম্যাগাজিনের নির্দিষ্ট পাতায় আটকে নেই । এখন তারা দর্শক মাতাচ্ছে ছোট-বড় পর্দায়। ছাপা কমিকসকে বেশ চাপে ফেলেছে এ ডিজিটাল মাধ্যমের জনপ্রিয়তা । প্রকাশকরা তাই এখন আর দৈনিক কিংবা মাসিক পত্রিকায় আগ্রহী নন, মনোযোগী ডিজিটাল কমিকসে।
কমিকস বিশেষজ্ঞদের অনেকেই তাই বলেন, এই নতুন সহস্রাব্দে সুপারম্যান অনেক বেশি মানুষ হয়ে গিয়েছে । ব্যাটম্যান ও গ্রিন ল্যান্টার্ন খুব একটা বদলায়নি । সুপারহিরোদের জগতে অনেক নতুন চেষ্টা থাকলেও শেষমেশ সেই পুরনো গল্পের ধাঁচেই ফিরে গিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা একটা বিষয়ে নিশ্চিত যে, কমিকস তৈরি, তার বিপণন এবং ব্যবসা সবই বদলাচ্ছে, সময়ের সঙ্গে আরও বদলাবে। তাহলে কি বদলাতে বদলাতে কমিকস বুক ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে ?
স্ট্যান লি নেই । তাঁরও আগে একে একে বিদায় নিয়েছেন মাইক ওয়েরিংগো, ডেভ স্টিভেনস, জনি ক্রেগ প্রমুখ জনপ্রিয় কমিক শিল্পীরা। তারপরও টিকেছিল জনপ্রিয় কমিকস বুক। কিন্তু তারপর…বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে একটা কমিক বই পলিব্যাগে সিল করে বাজারে এল। যার হলোগ্রাফিক প্রচ্ছদ জ্বলজ্বল করছে, সঙ্গে রয়েছে একটা ট্যাটু। বিক্রিবাটা চললো কিন্তু কিছুকাল। প্রসঙ্গত; নব্বইয়ের দশকে কমিক আঁকিয়ে বা শিল্পীরাই কিন্তু কমিক-বুকের দুনিয়া শাসন করেছেন। কারণ; কমিক তখন থেকেই হয়ে উঠছিল ভিজ্যুয়াল মিডিয়াম। কেবল তাই নয়; কমিক-এর বাজার কিংবা ব্যবসায় ওই সময়ে পুরোদমে রসদ জুগিয়েছে কমিক শিল্পীরা।
উল্লেখ্য ; জিম লির এক্স-মেনের প্রথম ইস্যুটি ৮০ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল । এককথায় জমজমাট ছিল প্রচ্ছদ থেকে গল্প, ছবি। ছিল একই সংস্করণে ছ’টি ভিন্ন প্রচ্ছদ, করেছিলেন মার্ভেল এবং ডিসি। সবাই ধরে নিল শুধু গল্প বা ছবি নয় ভিন্ন ভিন্ন ছ’টি প্রচ্ছদই সাফল্যের একমাত্র কারণ। প্রকাশকরাও ভাবতে শুরু করলেন যে আলাদা আলাদা প্রচ্ছদ করায় যদি প্রথম সংখ্যা এত বেশি বিক্রি হয়, তাহলে পরবর্তী সংখ্যাগুলির ক্ষেত্রে একই পথে হাঁটলে সাফল্য নিশ্চিত। কমিকের প্রচ্ছদে ক্রোমিয়াম ফয়েল-স্ট্যামড ছবি ব্যবহার শুরু হয়ে গেল। একে একে এল অন্ধকারে জ্বলজ্বলে প্রচ্ছদ এবং আরও কিছু। এতে যে সাফল্য মেলেনি তা নয়, ঝিমিয়ে পড়া কমিকের বাজার নড়েচড়ে উঠেছিল, কিন্তু কমিক-কাহিনি কিংবা তার ছবি ? ভাবা হয়েছিল ভক্তরা একই কমিকের ভিন্ন ভিন্ন প্রচ্ছদ কিনতে আগ্রহী হবে। কিন্তু গল্প, চরিত্র তখন থেকে এত কম মনোযোগ পেতে শুরু করল যে ভক্তদের একটা বিরাট অংশ কমিকে আর মজা না পেয়ে নিরুৎসাহী হয়ে পড়ে। বিক্রিও কমে। যেসব কমিকের বিক্রি ছিল ১০-২০ লক্ষ, সেগুলির বিক্রি নেমে আসে কয়েক লাখে। ছোট প্রকাশকরা প্রকাশনা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কিছু প্রকাশক নড়েচড়ে বসেন । এরপর কমিক লেখকদের গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। গল্পের দিকেও মনোযোগ ফেরে কিন্তু ততদিনে সময়ের চাহিদা বদলে গিয়েছে অনেকটাই, কমিকস ফিল্ম, টেলিভিশন শো এবং ভিডিওগেম দখল করতে শুরু করে শৈশব।
কমিক এসেছিল একশোরও বেশি বছর আগে পত্রিকার পিছনের পাতায় থাকা ফিলার থেকে। বিশ শতকের শুরুতে বেশ কিছু গল্প জন্ম নিয়েছিল কমিক স্ট্রিপে। আজ দৈনিক কিংবা পাক্ষিকে কমিক স্ট্রিপ পাওয়া মুশকিল। তবে পত্রিকার কমিক স্ট্রিপ থেকে কমিক বুকের জন্ম হলেও পরবর্তী সময়ে কমিক বুকের কাছেই কমিক স্ট্রিপ রাজত্ব হারায় । দ্য ইয়েলো কিড প্রথম সংবাদপত্র স্ট্রিপ । এরপর আউটকল্টের বাস্টার ব্রাউন, জর্জ ম্যাকমেনাসের দ্য নিউলিওয়েডস, উইনসর ম্যাককের লিটল নেমো ইন স্লাম্বারল্যান্ড ও বাড ফিশারের মুট অ্যান্ড জেফ ইত্যাদি। তারপর অ্যাডভেঞ্চার স্ট্রিপ-এডগার রাইস বারোজের টারজান, লি ফকের ম্যানড্রেক দ্য ম্যাজিশিয়ান, হ্যারল্ড গ্রের লিটল অরফান অ্যানি, চেস্টার গল্ডের ডিক ট্রেসি ও মিল্টন ক্যানিফের টেরি অ্যান্ড দ্য পাইরেটস। প্রথম কমিক বুক ১৯২৯ সালে দ্য ফানিজ।
এরপর ১৯৩৫ সালে ফেমাস ফানিজ: আ কার্নিভাল অব কমিকস। কমিক বুক বদলে যায় অ্যাকশন কমিক সিরিজ সুপারম্যান-এর আবির্ভাবে। সুপারম্যানের গল্প, আঁকা ছিল সিগেল ও জো শাস্টারের। একই সময়ে হাজির হয় ডিটেক্টিভ কমিকস ব্যাটম্যান। মার্ভেলের ক্যাপ্টেন আমেরিকা ও ডিসির ওয়ান্ডার উইম্যান এদের অনেক পরে। তখন সুপারম্যান, ব্যাটম্যান ও ক্যাপ্টেন মার্ভেল টাইটেলের বই মাসে বিক্রি হত ১৫ লাখ। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতি বদলায়। যুদ্ধ শেষে কমিক বুকের ভাঙা হাটে নতুন আলোড়ন আনে অপরাধ, রোমান্স, ওয়েস্টার্ন ও হরর, সায়েন্স ফিকশন নিয়েও কমিক বুক তৈরি হতে শুরু করে । সুপারম্যান, ব্যাটম্যানরা টিকে থাকে তবে অনেক সুপারহিরোর মৃত্যু হয়।
কমিকসের বাজার নতুন করে চাঙ্গা হয় ফ্যান্টাসটিক ফোর, দি অ্যাভেঞ্জারস, হাল্ক ও স্পাইডারম্যান আসায়। কমিকবুকের বাজার শাসন করত মূলত ডিসি ও মার্ভেল। ডিসির ঝুলিতে যেমন সুপারম্যান, ব্যাটম্যান অ্যান্ড রবিন, ওয়ান্ডার উইম্যান, অ্যাকুয়াম্যান, ফ্লাশ, গ্রিন ল্যান্টার্ন, গ্রিন অ্যারো, হকম্যান, দি অ্যাটম। মার্ভেলের তেমনি স্পাইডারম্যান, দি ইনক্রেডিবল হাল্ক, দ্য ফ্যান্টাস্টিক ফোর, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, দি এক্স ম্যান, ডেয়ারডেভিল, দ্য মাইটি থর, আয়রনম্যান। তবে ডিসি ও মার্ভেলের বাইরেও আরও কিছু কমিক চরিত্র জনপ্রিয়তা পেয়েছে, যেমন— স্পন ও হেলবয়।
দ্য হিস্ট্রি, মেথডস অ্যান্ড ম্যাডনেস-এর লেখক ক্রিস রেয়ল ও স্কট টিপটন-দের কথা মতো, এক সময় শৈশবের সঙ্গী ছিল মার্ভেল তারপর মন ছুটত ডিসি কমিকসের পিছনে। ফের মার্ভেল প্রবলভাবে ফিরে এলেও রয়ে যায় ডিসি। সাধারণ মূল্যায়নে বলা যেতে পারে ডিসির নজর ইতিহাস এবং চরিত্রগুলির আত্মীয়দের দিকে আর মার্ভেল সাময়িক কিংবা আরও বড় কোনও থিমের ওপর অনেকটা ঘটনানির্ভর স্টোরিলাইন। তবে এ ধরনের মূল্যায়ন যেকোনও সময়েই যে বদলে যায় কমিক নিজেই তার প্রমাণ।
4 Responses
অসাধারণ একটি লেখা, পড়ে একই সঙ্গে তৃপ্তি পেলাম সমৃদ্ধ হলাম।
কমিক্সের গোটা ইতিহাসটাই যেন পড়ে ফেললাম; সেই সঙ্গে আরু অনেক কিছু।
the good article in bangla is not visible, the essay on comics is excellent from above.
তথ্যনির্ভর লেখা অথচ সুখপাঠ্য।