সে শৈশব ইঁদুর রেসের নয় । সে শৈশব মহাকাব্যের দুপুর । সন্ধ্যার পর সুর করে ভেসে আসা কৃত্তিবাসী রচনার সুর । রাম, রাবণ, হনুমান, সীতাকে নিয়ে রামায়ণ-রামায়ণ খেলা— বনবাসের কুটির, লক্ষ্মণরেখার আঁক। পুতুল সংসারে সদ্য শোনা রাম কথার পুনর্কাহন । জমানো রাঙতায় ভাঁজ দিয়ে, মুকুট করে রামচন্দ্রের মেক আপ, গদা হাতে লঙ্কাকাণ্ড খেলা । সে এক শৈশবের রামরাজ্য ।
হ্যাঁ, এখনকার ছোটা ভীমের রাজত্বের বাইরে যে পৃথিবীটা, সেই শৈশব তো রামায়ণকে ঘিরেই। বাঙালির কাছে রাম যত বড় না ভগবান, তার থেকেও বেশি কিন্তু তিনি পাশের বাড়ির ছেলেটা । অঙ্কের প্রশ্ন থেকে ব্যাকরণের উদাহরণ, সবটাই জুড়ে তিনি বিরাজমান। কখনও তিনি মুদির দোকান চালান, কখনও আবার দারোয়ান, কখনও আবার চিকিৎসক, কখনও মোহন যোগে তিনিই ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ । বা কৃষ্ণ যোগে কথামৃত সুধাবর্ষণকারী |
বঙ্গজীবনে কালীপ্রীতি-কৃষ্ণপ্রীতি মধ্যে রামায়ণের অনুপ্রবেশ যিনি ঘটিয়েছেন, তিনি কৃত্তিবাস ওঝা । তাঁর কলমের জোরেই মুখে মুখে রামায়ণ, মহাকাব্যের হিরো রাম । ত্রেতা যুগের নায়ক কলিযুগেও দাপট চালাচ্ছেন কবিগুণে । কতই না কাণ্ড তাঁর (অথচ আজকের ‘রামভক্তদের’ অনেকেই জানেন না রামায়ণে আদতে কটা কাণ্ড)। সে যাই হোক না কেন, অব্রাহ্মণ, অকুলীন ভাষায় দেবভাষার মহাকাব্য কার অনুপ্রেরণায় কবি কৃত্তিবাস অনুবাদ করলেন ?
যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে, গৌরেশ্বরের অনুপ্রেরণায় রাজপণ্ডিত কৃত্তিবাস অনুবাদ করেন বাল্মীকির রামায়ণ । কিন্তু কে এই গৌরেশ্বর ? ড. সুকুমার সেন বলছেন, ইনি সুবুদ্ধি রায় বা সেন বংশীয় দনুজমাধব কিংবা চট্টগ্রামের দনুজমর্দন হতে পারেন । ড. দীনেশচন্দ্র সেন ও ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে ইনি রাজা গণেশ । আবার বসন্তরঞ্জন রায় বলছেন, ইনি গণেশ নন, বরং গণেশপুত্র যদু অথবা তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ । তিনি যেই হোন না কেন, গৌরেশ্বরের কথা মত কিন্তু কৃত্তিবাস ওঝা রামায়ণের অনুবাদ করেননি । বাল্মীকির ভাবনার সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছেন নিজের কবি ভাবনাও । হয়ত সে কারণেই রাম কাহনকে ‘শ্রীরাম পাঁচালি’ নাম দিয়েছিলেন কৃত্তিবাস । রবীন্দ্রনাথের মতে, কৃত্তিবাস আসলে তৎকালীন বাংলা সমাজকেই তুলে ধরেছিলেন তাঁর লেখায়।
এতো গেল বাংলার কবি ভাবনার একটা দিক । রামায়ণ নিয়ে কিন্তু কবি ভাবনার আরও একটা দিক রয়েছে । মধুকবির ভাবনা । রামকে হিরো করার বিপরীত ভাবনা থেকে তিনি লিখছেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। মধুসূদন দত্তের ভাবনায়, রাম ভিলেন হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকতেই পারে, তবে ট্র্যাজিক হিরো কিন্তু মেঘনাদই । বঙ্গজীবনে রামায়ণকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানও কিন্তু কম নয় ।
সামনেই রামনবমী । সেদিন রামের জন্মদিন কিনা জানা নেই । তবে রাম নিয়ে সেদিন মিছিল টিছিল বেরনোর কথা, রামচর্চায় মাতবেন সেনাবাহিনী । সে যাই হোক না কেন, রামায়ণ সম্পর্কে কয়েকটি অজানা তথ্য তুলে ধরা যাক ।
# রামরা কিন্তু শুধু চার ভাই নন। রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন ছাড়াও দশরথের একটি মেয়ে ছিল। তিনি আসলে রামের দিদি। কৌশল্যার সন্তান। তাঁর নাম শান্তা।
# বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে সপ্তম অবতার রাম। আবার বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম। রামকে বিষ্ণুর ধনুকে সুতো পরাতে বলেছিলেন পরশুরাম। কিন্তু প্রশ্ন হল, যদি যুগে যুগে অবতারের আগমন হয়, তাহলে এই দুই অবতারের দেখা হল কীভাবে ?
# রামের বনবাসের সময় লক্ষ্মণ এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমোননি । তাঁর হয়ে ঘুমিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী ঊর্মিলা। রামের চোদ্দ বছরের বনবাসে ঊর্মিলা কিন্তু একদিনের জন্যও ঘুম থেকে ওঠেননি।
# বাল্মীকির রামায়ণে লক্ষ্মণরেখার উল্লেখ নেই । তবে এই গল্প কোথা থেকে এল, তা নিয়ে অনেক মত রয়ে গিয়েছে । সে যাই হোক না কেন, কালক্রমে এই বিপদের সাবধানবাণী দিতে লক্ষ্মণরেখার প্রসঙ্গ ওঠে মুখে মুখে ।
# রাবণের জ্ঞানকে সম্মান জানাতেন রাম । রাবণের মৃত্যুর সময় লক্ষ্মণকে তিনি পাঠান তাঁর থেকে জ্ঞান আহরণের জন্য । লক্ষ্মণ তাঁর কাছে গিয়ে রাজনীতি এবং ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান নেন।
# লঙ্কায় সীতাকে আগলে রেখেছিলেন অগ্নি । সীতাকে নিজের কাছে রেখে সেখানে বসিয়েছিলেন দেবী দুর্গাকে । লঙ্কা থেকে দুর্গাকে নিয়েই নিজের রাজত্বে ফেরেন রাম । সেখানে অগ্নিপরীক্ষার সময় দুর্গাকে ফিরিয়ে নিয়ে সীতাকে ফেরত দেন অগ্নি । তবে রামের সঙ্গে থাকতে রাজি ছিলেন না সীতা। তিনি ধরিত্রীর গর্ভে প্রবেশ করেন। বলা হয়, ধরিত্রী হলেন সীতার বোন। আর সীতা হলেন দেবী লক্ষ্ণী।
# রাম রাজত্ব করেছিলেন প্রায় এগারো হাজার বছর । সেই রাজত্বকেই বলা হয় রামরাজ্য ।
# বারো লক্ষ বছর আগে রাম ত্রেতা যুগে ছিলেন বলে বিশ্বাস প্রচলিত। যদিও এই রামায়ণের গল্প লেখা হয় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে কোনও এক সময়ে।
2 Responses
বারো লক্ষ বছর আগে রাম ত্রেতা যুগে ছিলেন বলে বিশ্বাস প্রচলিত। যদিও এই রামায়ণের গল্প লেখা হয় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে কোনও এক সময়ে।
তাদের জীবন থেকে হিন্দুরা কি শিক্ষা পেল?