” দিবা নিশি যেই নরে, তামাকু ভক্ষণ করে,
অন্তকালে চলে যায় কাশী ’’ (তামাকু মাহাত্ব)
পর্তুগিজরা না এলে এ ছড়া হয়ত কোনও দিনই লেখা হতো না । হ্যাঁ, পর্তুগিজদের হাত ধরেই এসেছিল তামাক । তামাক সেবনের অভ্যাস সেখান থেকেই । তর্কবাগীশরা বলতেই পারেন, তাহলে শিব কী করে ভাঙ-সিদ্ধি-গাঁজা সেবন করে ? সে বিতর্কে আজ না-ই বা জড়ালাম । বলা যেতেই পারে—বালতি, পেরেক, বোতল, স্পঞ্জের মত বাংলার মানুষকে তামাক দান করেছেন পর্তুগিজরাই ।
শুধু কি তাই, বাংলার কৃষিকেও সমৃদ্ধ করেছেন পর্তুগিজরাই । পর্তুগিজদের হাত ধরেই এসেছে আনারস, আলু, পেঁপেঁ, বেগুন, টম্যাটো, মরিচ, ঢ্যাঁড়শ, আলফানসো আম, কাজুবাদাম, পেয়ারাও । তবে পর্তুগিজরাই একা বাংলার কৃষি এবং বাগানকে সমৃদ্ধ করেনি । এ পর্যায়ে পর্তুগিজরা একটু বেশি করলেও বাংলায় বিদেশি বণিকদের হাত ধরে গাছ-বৈচিত্র্য এসেছে । শুধুমাত্র বাংলার কৃষি জীবনেই নয়, নগরকে আরও গাছ দিয়েই সাজিয়ে তুলেছে বিদেশিরা ।
শহরের এই গাছগাছালিই আকর্ষণ করত আর্থার পল বেনথালকে । ডাক নাম পল । শৈশবে বেশিরভাগ সময়েই অসুস্থ থাকতেন পল । ভাল ছাত্র ছিলেন । হিসাববিদ্যা নিয়ে পড়াশুনো । ১৯২৪ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সেই মোটা বেতনের চাকরি পান । কোম্পানির নাম বার্ড অ্যান্ড হাইজার । মূলত পাট ব্যবসা দেখত এই সংস্থাটি । কলকাতার উপকণ্ঠে জুটমিলে কিছুদিন, কলকাতায় কয়েক বছর কাটিয়ে বেনথাল বদলি হন বাংলাদেশে । সেখানেও অফিসের কাজ দেখার দায়িত্ব তাঁর । কর্তৃপক্ষের ক্রমশ নেক নজরে পড়ে যাওয়া এই তরুণ কর্মচারী সংস্থায় উচ্চপদ লাভ করেন । একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন—‘By the time the Second World War broke out I was a partner in the firm. ’ ( Merchants of the Raj: British Managing Agency Houses in Calcutta Yesterday and Today)।
পরবর্তী সময়ে তিনি নাইটহুড লাভ করেন । মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত পরিচিত ছিলেন স্যার পল বেনথাল নামেই । চাকরির পাশাপাশি তাঁর শখ ছিল গাছ নিযে । আগেই বলেছিলাম । একদিন তিনি ঠিক করে ফেললেন কলকাতার গাছগুলিকে নিরীক্ষণ করবেন তিনি। যেমন ভাবা তেমন কাজ ।
বেরিয়ে পড়লেন শহরের পথে প্রান্তরে । বড়লোকের বাগানও ঘুরলেন । সালটা ১৯৩৮-৩৯ । একদিন-দুদিন নয়, টানা প্রায় কয়েক বছর । এরপর তিনি লিখলেন, ‘Trees of Calcutta and its Neighbourhood’। ‘Trees of Calcutta and its Neighbourhood’-এ স্যার পল বেনথাল শহরের মোট ২৭৬টি গাছের পরিচয় দিয়েছেন । ৯১টি এদেশীয়, ৫০টি এশিয়া মহাদেশের, ১৪টি আফ্রিকার, ৪২টি আমেরিকার, দক্ষিণ সাগর দ্বীপের ১টি । বাকি ৬৯টি বুনোগাছ । বৃক্ষসুমারি বললেও কম বলা হয় । এই গাছগুলির চরিত্র কী, বিভিন্ন অংশের গুণাগুণ, এদের সায়েন্টিফিক নাম, লোকায়াত বিশ্বাস থেকে উপকথা—সব কিছুকেই সংগ্রহ করেছিলেন বেনথাল ।
যেমন, লোকায়ত বিশ্বাস অনুযায়ী বাংলার বট-অশ্বত্থের সঙ্গে তিনি তুলনা করেছেন খ্রিস্টানদের ডুমুর গাছের । এছাড়াও রয়েছে ছবি । বেনথাল বলে গেছেন, শহরের গাছ চেনার সূচনা হোক ময়দান চত্বর থেকেই । কারণ শহরের ফুসফুসেই তো এই গাছগুলি সাক্ষ্য বহন করে চলেছে বহু ইতিহাসের । ময়দানে তিনি পেয়েছিলেন চালতা গাছ । ১৯৪৪ সালে ময়দানের তেঁতুল গাছটি মানুষের উপদ্রবের কারণে কেটে ফেলা হয় । তবে ময়দানেই কিন্তু থেমে থাকেনি বেনথালের ‘Trees of Calcutta and its Neighbourhood’-এর অন্বেষণ । ডালহৌসি স্ক্যোয়ারে বকফুল, আলিপুরের হর্টিকালচারে কর্পূর, হেস্টিংস হাউসে ইলাং ইলাং, আরও কত জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা রকমের গাছ ।
১৯৪৫-৪৭ পর্যন্ত স্যার পল বেনথাল ছিলেন রয়্যাল এগ্রি-হর্টিকালচার সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট । সে সময়ই তাঁর ‘Trees of Calcutta and its Neighbourhood’ বইটি প্রকাশিত হয় । ১৯৪৬ সালে বইটি প্রকাশ করে লন্ডনের থ্যাকার স্পিঙ্কস অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড। শিয়ালদহের সবস্বতী প্রেস থেকে ছাপা হয় । তবে দুঃখের বিষয় বইটি এখন আর ছাপা হয় না । শহরের বৃক্ষ সুমারির ইতিবৃত্ত ‘Trees of Calcutta and its Neighbourhood’ পাওয়া যায় হাতে গোনা দু-তিনটে লাইব্রেরিতেই ।
(পুনর্মুদ্রিত)
2 Responses
khub sundor tothyosomriddho lekha…anek kichhu jante pari emon lekha theke
দারুণ! সমৃদ্ধ হলাম।