হিমানী শব্দটাই এমন যে সারা দেহে আরাম ঘনিয়ে আসে। শীত মানেই যে সব সময় আরাম তা নয়। আরাম তখনই, যখন তা ঠেকাবার ক্ষমতা থাকে। হাত, পা, ঠোঁট সব ফেটে ফুটিফাটা। নারকেল তেল আর গ্লিসারিন ছাড়া গতি নেই। তার ফলে জামা কাপড়, মোজা সব তেল চিটিনি। একমাত্র নতুন বউদি বা ছোটকাকিমার ড্রেসিং টেবিলে ঝলমল করছে সাদা স্নো, ঝকঝকে কাচের শিশিতে। সুগন্ধি তেলের গন্ধ তার স্নান ভেজা খোলা চুলে। গায়ে জড়িয়ে আছে নতুন শাড়ির সুগন্ধও। পায়ের নূপুর, কোমরের চাবিতে ঝুন ঝুন, টুংটাং। তারই মধ্যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, শিশির ঢাকনা খুলে ডান হাতের তর্জনীতে এক টিপ নিয়ে, বাকি আঙুলে শিশির ঢাকা বন্ধ করে টুং করে টেবিলে রাখল। এবার চুড়ির রিনরিন। তর্জনীতে লাগানো ওই নরম স্নো, সারা মুখে টিপ টিপ করে লাগিয়ে আস্তে আস্তে ডলে মাখল আদরে। হ্যাংলা চাহনি দেখে আমাদেরও এক টিপ দিত। মুখে মাখলে নরম ঠান্ডায় চোখের পাতাও বুজে আসত। ঘর থেকে উঠোনে বেরোলে আরও আরাম। শীতের বাতাস আছে কিন্তু কাঁটা বিঁধছেনা। আর, মুখ জল দিয়ে ধুলেই মোলায়েম, কিন্তু তেলতেলে নয়। সেই থেকে আমার মন প্রাণ জুড়িয়ে থাকত, নতুন বউয়ের স্নো, পাউডার আর গায়ে মাখার লোশন বসন্তমালতী।
ঠাট্টা ইয়ারকিতেও স্নো-সাবান-পাউডার।কালো ছেলেকে ঝকঝকে লাগা মানেই স্নো মেখেছে। শ্যামবর্ণা মেয়েকে স্নো ঘষে ফরসা করার রুপটান দেওয়া হতো। তবে কেউ কেউ বেশি করে স্নো ঘষলেই মুখটা যে একটু ছাই ছাই লাগতো তাতে কোনও সন্দেহ নেই। খুব কম মেয়েই ছিল যারা তাদের নিত্য প্রসাধনে হিমানী ব্যবহার করত না।
তো, কোম্পানির নাম হিমানী লিমিটেড বলেই সেই স্নো এর নামও হিমানী। এমনকি তার আগে থেকে জাঁকিয়ে ব্যবসা করা আফগান স্নো বা পরে আসা কান্তি স্নো বা আরতি স্নো– সবই হয়ে গেল হিমানী। অনেকটা সেই ভাবে যে ভাবে সব বনস্পতিই, ডালডা। তার অবশ্য কারণও কিছু আছে। প্রথম কারণ সম্ভবত স্বদেশিয়ানা। রাজপুতানার এক স্বপ্নসন্ধানী তরুণ যুবা গন্ধদ্রব্য ব্যবসায়ী ইব্রাহিম সুলতানালি পাঠানওয়ালা বম্বে আসেন। পরে ১৯০৯ সালে চাকরি ছেড়ে বিদেশি সংযোগে নির্যাস আনিয়ে তাঁর নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে বানাতে থাকেন প্রসাধনী এবং ব্যবসায়িক ভাবে বিক্রি শুরু করেন। এদেশের রাজারাজড়া এবং ইংরেজ নারী পুরুষের কাছে সমাদর পান। পরে ঘরোয়া প্রসাধনী স্নো তৈরি করে, নামহীন সেই প্রোডাক্টটির উদ্বোধনে নিয়ে আসেন আফগানিস্থানের রাজাকে। এই তুষার ধবল বস্তুটি দেখে উচ্ছ্বসিত রাজা মশাই ১৯১৯ সালে এর নাম করণ করেন আফগান স্নো। এটি ভারতবর্ষের প্রথম ফেস ক্রিম। পরে অসহযোগ আন্দোলনের সময় ‘বিদেশী’ তকমায় তা বয়কট আন্দোলনের ফর্দে পড়ে। কারণ এর প্যাকেজিং বোতলটি আসত জার্মানি থেকে এবং লেবেলটি আসতো জাপান থেকে। তখন গান্ধীজীর শরণাপন্ন হয়ে তাঁকে বোঝাতে, গান্ধীজী এটিকে স্বদেশী বলে ঘোষণা করাতে বয়কট উঠে যায়। কিন্তু এরপর দেশবিভাগ জনিত ক্ষোভে এটি আবার কিছুটা সঙ্কটে পড়ে।
পরে অবশ্য এই পাঠানওয়ালা বম্বেতেই ব্যবসা জমান এবং তা খুবই সফল হয়। দেবিকারানি থেকে পদ্মিনী কোলাপুরে, কয়েক প্রজন্ম জুড়ে এই তাবৎ অভিনেত্রীদের মুখ এর বিজ্ঞাপনে পাওয়া যাচ্ছে। ইন্দ্রাণী রেহমান, সেই প্রথম মিস ইন্ডিয়াকেও ইনি পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তবু, পরাধীন ভারতে প্রবল বাঙালিয়ানা ও স্বদেশপ্রেম থেকে শুরু হয় হিমানী স্নো, যার সরকারি অধিগ্রহণ হয় ১৯৪৯ সালে, হিমানী লিমিটেড এই নামে। একেবারে রেজিস্টার্ড ব্যবসা, তবে “কোম্পানি লিমিটেড বাই শেয়ারস। সঙ্গে আবার হিমানী গ্লিসারিন সাবান। ৩নং খেলাত বাবু লেন- কলকাতা ৩৭, এই ঠিকানায় অফিস হলেও কারখানা ছিল উত্তর কলকাতার বিটি রোডে।

HIMANI TOILET SOAPS & PERFUMES
Of Rare Collection & purity have been highly appreciated in the National Congress Exhibition, Lahore, by gentlemen coming from all parts of India
Says Pt. Jawaharlal Nehru, President, Indian National Congress, Lahore, “I have used your WHITE HIMANI SOAP and have liked it. I think it is a very good soap”
ALWAYS INSIST ON
Non- Greasy
HIMANI SNOW
For the Complexion
TOILET SOAPS
Made according to latest Scientific Principles
HIMANI SOAPS
Nirupama, Khus Khus, Sandal, White Rose, Bakul etc etc
BIJOLINI SOAP
For quick & Economic Washing
Sole agents for the Punjab & N.W.F.P
Laurels Ltd.
The Mall, Lahore
Wanted – sub agents in unrepresented areas
The Tribune, 21 January 1930
আরও একটি সূত্রে দেখা যাচ্ছে যে, দ্য ট্রাইবিউন কাগজে, ২১ জানুয়ারী ১৯৩০, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নেহরুর নাম ছাপিয়ে হিমানী স্নো ও সাবানের উৎকর্ষ জানানো হচ্ছে এবং নির্ভরযোগ্য এজেন্টও চাওয়া হচ্ছে, বিশেষত লাহোরে এর বিক্রি বাড়ানোর জন্যে। এও জানানো হছে যে লাহোরে জাতীয় কংগ্রেসের প্রদর্শনীতে এর উৎকর্ষ, ভারতবর্ষের নানা প্রদেশ থেকে আসা বিশিষ্টজনের কাছে প্রশংশিত হয়েছে। আফগান স্নো-কে বয়কটের তালিকায় রেখে এভাবেই স্বদেশি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা শুরু হয় হিমানী স্নো এবং হিমানী লিমিটেডকে।হিমানী নামের সঙ্গে স্নো এমনি এমনিই জুড়ে গেল এবং অর্থটিও এক রইল আবার বাঙ্গালিয়ানায় স্বদেশী ভাবটিও বজায় রইল। কিন্তু পুরো লেখাটিই ইংরেজিতে, বাংলায় নয়।

পরে বারিদবরণ ঘোষের সম্পাদনায় “চিত্রশিল্পী হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার” এই শিরোনামে ১৯২৪-এর পরে চিত্রীর আঁকা বহু আর্টপ্লেট-সহ যে বইটি ছাপা হয় সেটিরও প্রকাশক “নিরুপমা বর্ষ স্মৃতি”- হিমানী লিমিটেড। স্বাধীনতার পর এর সরকারি অধিগ্রহন হল এবং তা চলল সত্তর বছর। আপাতত স্ট্রাইকের ফলে এটি বন্ধ। নিড়েনির খোঁচাখুঁচিতে এইটুকু শিকড় ছুঁয়েই ইচ্ছে করে শাবল গাঁইতি নিয়ে লেগে পড়তে। স্নো মাখা এমন রাজনীতিকরণ, রাষ্ট্রনীতির এমন চাল, সহজে হাতছাড়া করা যায়!না করা উচিত?
তবে আপাতত এইসব কচকচি তুলে রেখে, ফিরে যাই নতুন বউদির সেই ড্রেসিং ইউনিটে, যেখানে শীতের বরফও হিমানী সুগন্ধে ভরপুর! কিন্তু যাই কি করে! কারণ, যে নানা প্রসাধনীর ঢল এখন আমার ড্রেসিং ইউনিটে তার সিংহভাগই বিদেশী। বহুজাতিক কোম্পানি বললে অপরাধবোধ একটু ঝাপসা হয়। আর শুধু কোম্পানিগুলিই নয়, এর গুণদ্রব্যগুলিও অন্য মাটির ভিন্ন ভেষজ। আর সেই হিমানী মাখা, গান্ধিবাদী যে দু’এক পিস মাসি-কাকি আশি পার করে টিম টিম করছেন, তাঁরাও এখন দেশদ্রোহী। ছেলে মেয়ের এনে দেওয়া বিদেশী প্রসাধনীতেই বহুকাল অভ্যস্ত। কিন্তু মজা এই যে এই “হিমানী” নামটা এতটাই আদরকাড়া যে এখনও বহু কোম্পানি এটি ব্যবহার করছে। এমনকি নেট ক্লিক করতেই মিষ্টি এক মেয়ের মুখ লাগানো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ভেসে এল– নাম “হিমানী স্নো”।আর কোনও কথা হবে? না না না ।