নাঃ, মোটেই ‘ভদ্র’ ভাষার শহর নয় কলকাতা । আড্ডা হোক কিংবা বাসের রেষারেষি—কথায় কথায় খিস্তি, স্ল্যাং, কান পাতা দায় । কী ভাষা ! ছিঃ ! প্রথমেই তাই সতর্কীকরণ দিয়ে রাখি, ‘কলকাতার স্ল্যাং’ শুনে এতদিন কান গরম তো হয়েছে, এ লেখা পড়লে চোখ গরমও হয়ে যেতে পারে । তাই মন যদি হয় আঠারোর বেশি, ‘খোকাপনা বা খুকুপনা’ যদি চলে গিয়ে থাকে তবে চিত্ত হবে না চঞ্চল । আর সূত্র ? সে না হয় নিজেরাই খুঁজে বের করুন।
এতদিন যা জেনে এসেছেন, তা ঠিক জানেন—কলকাতা কথায় কথায় ‘স্ল্যাং’ বলে । শুধু বলে না, নানা ভাষায় গালাগাল দেয় কলকাতা । এর প্রধান কারণ হল, কলকাতার জন্ম যবে থেকে, তার অনেক কাল থেকে ‘খিস্তি’ দিচ্ছে বাঙালি । এ প্রসঙ্গে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কথাকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন ভাষাবিদ পবিত্র সরকার, ‘অনেকে মনে করেন যে, কলকাতার আদিম অধিবাসীদের ভাষা আদৌ
ভদ্রজনের ভাষা ছিল না, কারণ সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগ থেকে অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত—এই সময়কালে কলকাতায় বাস করত মূলত জেলে, ধোপা, সাধারণ কৃষক প্রভৃতির মতো মানুষ…’
এই জেলে, ধোপা, কৃষকের ভাষা কী ‘খিস্তি খেউর’ ? এ প্রশ্নটা অনেকেই তুলতে পারেন। গবেষকদের একটা বড় অংশ মনে করেন, ‘বাংলায় বৃটিশ দাপট শুরু হওয়ার আগে এবং পরে বাংলা ভাষায় একটি বড়সড় ক্র্যাক লক্ষ্য করা যায়। তার আগে পর্যন্ত…শব্দের গুরুচণ্ডাল ভেদ ছিল না।…তখন বাংলা সাহিত্য স্ফুরিত হতো মূলত কামার-চামার-মালাকার-কুমোর-জোলা-তাঁতি-ধুনুরী-নাপিত-গোয়ালা-মুচি-মেথর-বৈরাগী-ভিকিরিদের মাধ্যমে।’
অর্থাৎ স্ল্যাং বা খিস্তির প্রচলন কলকাতা গড়ে ওঠার অনেক আগে থেকে । যখন কলকাতা শহর হয়নি, তখন গ্রামবাংলারও যা ভাষা, কলকাতারও তাই ।
কীরকম সেই ভাষা ? মধ্যযুগে কবির নামও বদলে দিয়েছে খিস্তি । কবি সেই খিস্তিকে আশ্রয় করে বিখ্যাত হয়ে আছেন আজও। তিনি বড়ু চণ্ডীদাস। কবির আসল নাম অনন্ত। গবেষকদের একটা অংশ মনে করেন, ‘নীচজাতীয়’ মহিলার প্রেমে পড়েছিলেন বলে তাঁর নাম হয় বড়ু চণ্ডীদাস। প্রসঙ্গত এই বড়ু শব্দটি আসলে হল একটি খিস্তি ।
তাঁর লেখা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ সম্ভবত মধ্যযুগীয় বাংলায় কী ধরনের ভাষা ব্যবহার হতো, তার একটি দিক দেখিয়েছে । ‘বিপুল নিতম্বদোল’, ‘কুচ কোকযুগলা’, ‘ঢেমন-ঢেমনী’, ‘পামরী ছেনারী’ ইত্যাদি শব্দগুলি বহুল ব্যবহৃত এই গ্রন্থে । পরবর্তী সময়ে মঙ্গলকাব্যে স্ল্যাংয়ের ছড়াছড়ি ।
মেয়েরা কী ভাষায় কথা বলেন, তার হদিশ ‘অন্নদামঙ্গল’-এ দিতে চেয়েছেন ভারতচন্দ্র—‘আমার পতির আছে বড় এক ভুড়ি / খুঁজে পাই না লিঙ্গদেশ, কামনায় মরি।’ পরবর্তী সময়ে আধুনিক স্ল্যাংয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় কৃত্তিবাসী রামায়াণে—‘টিটকিরি’, ‘ঘুচাইব শনি’, ‘বেটা’ ইত্যাদি।
এবার আসা যাক, কলকাতার প্রসঙ্গে। নিছকই বাণিজ্যিক কারণ। আর সে জন্যই ঝোঁপ-জঙ্গল সরিয়ে গ্রাম হয়ে উঠল মহানগর। নগর জীবনের প্রয়োজনে বিভিন্ন জেলা, অঞ্চল এবং প্রদেশ থেকে লোকজন
এসে বসতি স্থাপন শুরু করল, আর সে কারণেই কলকাতায় এক মিশ্র ভাষা গড়ে উঠল। প্রসঙ্গত যাঁরা এলেন, তাঁদের বেশিরভাগই কিন্তু ‘শুদ্ধ’ কথ্য বলেন না । কথায় কথায় তাঁদের মুখেও খিস্তি। এই খিস্তিও মিশে গেল কলকাতার মানুষের ভাষায় । এক ‘খিস্তি সংস্কৃতির’ বাহক হয়ে উঠল কলকাতা ।
ভাষাশিক্ষা শাসনের হাতিয়ার । সাহেবদের কাছে তাই বাংলা ভাষা পাঠের প্রয়োজন ছিল। হেস্টিংসের নির্দেশে ১৭৭৮ সালে রচিত ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড-এর ‘A Grammar of Bengal Language’ বইয়ে এমন কিছু শব্দ আসে, যেগুলি স্ল্যাংয়ের আওতায় পড়ে। তবে উইলিয়াম কেরি সচেতনভাবে বাংলা খিস্তি বা স্ল্যাংয়ের সম্ভার তুলে ধরেন। ১৮০১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘কথোপকথন’-এ প্রথম বঙ্গসমাজের মেয়েদের কথোপকথন এবং কোন্দলের রূপটি উঠে আসে। পরবর্তী সময়ে এই কাজটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শব্দ সংগ্রহের মধ্যে আধুনিক স্ল্যাংয়ের উল্লেখ প্রচুর। যেমন—‘ঢলানি, আলুদোষ,চোপা, দামড়া, নাটা, ঢলাঢলি, চাটান, লুচ্চামি, চুকলিখোর’, তার মধ্যে কয়েকটি মাত্র |
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যে নব্য বাবু সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল কলকাতার বুকে, তথাকথিক ‘ভদ্দরলোক’ যাঁদের উল্লেখ করা যায়, তাঁদের মুখের মাত্রা ছিল খিস্তি । বাড়ির ‘চাকর’ হোক কিংবা যৌনকর্মী, তাঁদের উদ্দেশ করে বাবুর খিস্তি খেউড় তো মুখের মাত্রা । আজকের মত তখনও দৈনন্দিন জীবনে খিস্তি ছিল অনর্গল ।
এই ‘খিস্তি কালচার’-এর মধ্যে যে পারফর্মিং আর্টগুলি জনপ্রিয় হয়েছিল তার মধ্যেও খিস্তি দেওয়ার কোনও বাধা ছিল না । যেমন কবিগানে খিস্তি ছিল একেবারে মুড়ি-মুড়কির মত বিষয় । বাবা-কাকা-মা সবাই আসছেন কবিদের গানে । ভোলা ময়রা বলছেন—‘ঘোমাটা খুলে চোমটা মারে কোমটা বড় ভারি…’ আবার অ্যান্টনি কবিয়াল বলছেন, ‘এই বাংলায় বাঙালীর বেশে আনন্দে আছি/ হ’য়ে ঠাকুর সিংহের বাপের জামাই, কূর্তি টুপি ছেড়েছি…’
আবার পাঁচালি গানেও খিস্তির ব্যাপক প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। দাশরথি রায় লিখছেন—‘যত পেঁদির বেটা রামসন্না…’ নাটকেও খিস্তির প্রবল প্রভাব। উদাহরণ হিসেবে তারকচন্দ্র চূড়ামণির ‘সপত্নীনাটক’-এর একটি সংলাপ—‘আমরা হল্যেম কুলীন মাগ, স্বামী কেমন সামগ্রী, তার ধন ভাল করে চখেও দেখিনি । কর্ব্বো কি বল? খাট ভাঙিলি ভুঁই শয্যা ডাকের কথাই। আমরা কি আর পোঁদে কাপড় দিনা গ্যা । না কাল কাটাই না ?’
কুভাষা বা স্ল্যাংয়ের ব্যাপক প্রভাবটা নাটকের ক্ষেত্রে থেকে গিয়েছিল অনেক দি ন। এমনকি পরবর্তী সময়ে পপুলার নাট্যমঞ্চ হয়ে গেল দুই বড় শিল্পীর দ্বন্দ্বপ্রকাশের জায়গা। এখানে যেন কবিগানের সঙ্গে মিলে গেল নাটক। উৎপল দত্ত লিখছেন—‘দুজন বড় মাপের শিল্পী এক মঞ্চে অভিনয় করতে এলেই দ্বন্দ্ব বাধবে, এও যেন দর্শকরা ধরেই নিতেন এবং কীভাবে একজন আরেকজনকে মঞ্চের ওপর জব্দ করে দিলেন, এই সব ছিল দর্শকদের মুখরোচক আলোচ্য…স্পষ্টই বোঝা যায়, কলকাতার বাবু কালচারের কদর্য ঐতিহ্য এই নাট্যে প্রতিফলিত হচ্ছিল ; খিস্তি খেউড়ের কবিগানের অশ্লীল দিকটি ভর করেছিল বাংলা নাট্যশালায়…’
স্ল্যাংয়ের কবল থেকে নিজেদের সৃষ্টিকে দূরে রাখতে পারেননি বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথও। দুজনেরই লেখায় স্ল্যাংয়ের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ‘বিসর্জন’ নাটকে রবি ঠাকুর লিখছেন—‘সেদিন ও ব্যক্তি শালা পর্যন্ত উঠেছিল…মাইরি বলছি…’ আবার ‘নৌকাডুবি’-তে ‘ইহাকেই বলে পিলহারামি…’
যত সময় গড়িয়েছে, খিস্তি ততই বেড়েছে। গদ্য, পদ্য, নাটক, ছড়ায় নতুন নতুন স্ল্যাংয়ের জন্ম হয়েছে। শুনলে অনেকেই অবাক হবেন, খিস্তি খেউড় বা স্ল্যাংয়ের অভিধান বারবার বাংলায় লেখা হয়েছে। তাই খিস্তি বা স্ল্যাং নিয়ে এত নাক সিঁটকানোর কিচ্ছুটি হয়নি। মনে রাখবেন এ আমাদের কথ্য ভাষা। বাংলা ভাষা নিয়ে যাঁরা আজ মাতামাতি করছেন, যাঁরা ভাষার মধ্যে আবার ‘অশ্লীলতা’ খোঁজেন, ‘খিস্তি’ শুনলেই ‘ছিঃ’- ‘ইস’ করেন, তাঁদের উদ্দেশে একটাই কথা । বাঙালির প্রিয় মানুষ বিবেকানন্দ নিজে
বলছেন—‘স্বাভাবিক ভাষা ছেড়ে একটা অস্বাভাবিক ভাষা তয়ের করে কি হবে?…স্বাভাবিক যে ভাষায় মনের ভাব আমরা প্রকাশ করি, যে ভাষায় ক্রোধ দুঃখ ভালোবাসা ইত্যাদি জানাই, তার চেয়ে উপযুক্ত ভাষা হ’তে পারে না…’