সে অনেক কাল আগের কথা । এক সান্ধ্য আড্ডায় এক বন্ধু গর্ব করে তার জাত নিয়ে কথা বলেছিল। সে বেনে, তাই তার কাছে সোনাদানা প্রচুর । এরপর থেকে বন্ধুদের এক মজার খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই সদ্য কৈশোর পেরনো তরুণ। অন্য বন্ধুরা তাকে ‘বেনেপুকুরের বেনে’ বলে ডাকা শুরু করে। এই শব্দদ্বয় তাকে যে খুশি করতে পারেনি, তা বলা-ই বাহুল্য। তবে খুশি না হওয়ার মতো কোনও কারণ নেই। বেনিয়ান বা বেনেদের নিয়েই গড়ে উঠেছিল আজকের বেনিয়াপুকুর বা বেনে পুকুর। হ্যাঁ, এই অঞ্চল বেনে বা বেনিয়া অধ্যুষিত। তবে এক কালে তা গড়ে ওঠেনি। সম্ভবত মঙ্গলকাব্যের যুগ থেকেই এখানে বণিকদের বাস গড়ে ওঠে।
আর জোব চার্নকের সময়কালে তা যে আরও বেড়ে যায়, এ কথা প্রায় হলফ করে বলা যায় । কারণ, মধ্য কলকাতার এই অঞ্চল, অধুনা বেনেপুকুরের অদূরেই ছিল বৈঠকখানা । সেখানে একটি ব্যবসায়িক বন্দর গড়ে তোলেন চার্নক। কারণ, সার্কুলার রোড ছিল তখন পরিখা। এই পরিখা ধরে খিদিরপুর পর্যন্ত গিয়ে গঙ্গার মূল স্রোতে যেমন যাওয়া যেত, তেমনই আদিগঙ্গা ধরে সুন্দরবন পেরিয়ে সমুদ্রযাত্রাও খুব কষ্টসাধ্য ছিল না। আবার
গোবিন্দপুর খালের সঙ্গেও সংযুক্ত থাকার কারণে আজকের সল্টলেক পেরিয়ে বিদ্যাধরী নদী হয়ে জলপথে আন্তঃ-রাজ্য বাণিজ্য ছিল অনায়াস।
তাই পরিখার পাশে জঙ্গল পরিষ্কার করে গড়ে ওঠে জনবসতি। ধীরে ধীরে তার মধ্যে সম্ভবত বণিক অধ্যুষিত অঞ্চলটি হয় বেনিয়াপুকুর বা বেনেপুকুর। তবে সেই নামকরণ হয়ত উনিশ শতকের প্রথম দুই-তিন দশকের মধ্যে। কারণ, মানচিত্রে বেনেপুকুরের নাম ছিল না। নাম ছিল সংলগ্ন জাননগরের নাম। জাননগর এই জনপদ গড়ে ওঠার প্রমাণ দেয়। যেমন প্রমাণ দেয় অদূরের দরগা রোড। এই দরগা রোডের দরগা হল পীর গোরাচাঁদের নামে। সংলগ্ন গোরাচাঁদ লেন বা গোরাচাঁদ রোডও তাঁর নামেই। ১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে পীর গোরাচাঁদ মক্কা থেকে ভারতে আসেন। এরপরের বছর, তিনি বাংলার শ্রীহট্টে যান এবং তারপর ২১জন পীরভ্রাতাকে নিয়ে তিনি দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মপ্রচার করেন ।
তাঁর যাত্রাপথ থেকে অনুমান করা যায়, তিনি এই অঞ্চলে এসেছিলেন এবং এখানেও ধর্ম প্রচার করেছিলেন। এবং তা থেকেই ধরে নেওয়া যায়, সে সময়ও অর্থাৎ চতুর্দশ শতকেও এই এলাকায় জনবসতি ছিল। সেই জনপদের প্রতিটি মানুষকে এতটাই প্রভাবিত করেন তিনি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্তও এখানে গোরাচাঁদের মেলা হত প্রতি বছর। মেলায় আসতেন বাউল ফকিররা। বনবিবির পুজোও হতো। আর বনবিবির পুজো থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়, আজকের বেনেপুকুর অঞ্চল আদতে এক সময় ছিল ঘন জঙ্গল। জঙ্গল থেকে জনপদ গড়ে ওঠার পর যে সম্প্রদায়ের মানুষরা এখানে বাস করতেন, তাঁরা মূলত নিম্নবর্গীয়। বিশেষ করে পরিখা তীরবর্তী এলাকা, আর অদূরেই বাংলার দুটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। তাই জেলে সম্প্রদায়ের থাকার সম্ভাবনা প্রবল। এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তথ্যকে একত্রিত করলে বোঝাই যায়, তাঁদের অনেকেই মাছ ধরতে যেতেন, আর মাছ ধরতে গিয়ে যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, তাই বনবিবির আরাধনাও করতেন।
আবার এই অঞ্চলেই ছিল বাবাঠাকুর বা ধর্মঠাকুরের মন্দির । সুতরাং বাংলার সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকার মত এখানে যে লৌকিক বিশ্বাস থেকে ধর্মঠাকুর প্রবেশ করেছিলেন সাধারণের জীবনে এ কথা তো বলা-ই যায় । এই মানুষগুলিই একত্রিত হয়ে গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি । লৌকিক গানের এক সময় খুব প্রচলন ছিল এই এলাকায়। গোরাচাঁদের মেলাতে আউল বাউল ফকিররা আসতেন। আবা গান বাজনার প্রচলনের প্রমাণ বহন করে চলেছে ডুগডুগি পাড়া লেন। এখানে কয়েক বছর আগে পর্যন্তও বাদ্যযন্ত্র ডুগডুগি এবং ঢোল তৈরি হতো। স্থানীয় সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটিশ আমলে এখানে অনেক ঢেঁড়াওয়ালা বাস করতে শুরু করেন। সেই ঢেঁড়াওয়ালাদের বংশধরেরা আজও রয়ে গিয়েছেন অনেকেই।
এ তো গেল এলাকার বিবরণ। কিন্তু বেনেপুকুর এলাকার সঙ্গে কেন জুড়ে গেল পুকুর। জনশ্রুতি, এই এলাকায় প্রচুর পুকুর এবং ডোবা ছিল। বেনেপুকুর লেনে ছিল দুটি পুকুর। এছাড়াও গুলপাড়া বস্তির পুকুর, লিন্টন স্ট্রিটের পুকুর এবং বর্তমান লেডিব্রেবোর্ন কলেজ যেখানে, সেখানেও একটি পুকুর ছিল। আর সে কারণেই অঞ্চলের নামের সঙ্গে জুড়ে যায় পুকুরের নাম। উনিশ শতকের মধ্যভাগে বেনেপুকুর বেশ জমজমাট। একদিন এই পাড়াকে আরও
ঐতিহ্যশালী করে দিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। রাধারমণ মিত্র লিখছেন, ‘২২ নম্বর বেনেপুকুর রোড । এই বাড়িতেই উত্তর পাড়া থেকে ফিরে এসে মাইকেল মধুসূদন স্ত্রী হেনরিয়েটা, কন্যা শর্মিষ্ঠা এবং শিশুপুত্র নিয়ে থাকতেন । এই বাড়িতেই মিঃ ফ্লয়েডের সঙ্গে শর্মিষ্ঠার বিয়ে হয়। আর বিয়ের পরই এই বাড়ি থেকে মধুসূদন প্রেসিডেন্সি জেনারেল হসপিটালে ভর্তি হন। এই বাড়িতেই ১৮৭৩ সালের ২৬ জুন হেনরিয়েটা মারা যান…’
যাই হোক, বেনেপুকুর বা বেনিয়াপুকুরের কথা বললে, স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা অবশ্যই এসে পড়ে। এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল অনুশীলন সমিতির গোপন ঘাঁটি—‘১৯২০ সনে অন্তরীণ, জেল ও বন্দীশিবির থেকে অনুশীলন সমিতির যে সব কর্মী ছাড়া পেয়েছিলেন সেই সব কপর্দকশূন্য কর্মীদের ৪৭ নম্বর বেনেপুকুর রোডে পুকুর ও বাগান-সহ একটা দোতলা বাড়িভাড়া করে নিখরচায় থাকা ও খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ব্যবস্থা করেছিলেন ও সমস্ত খরচ যোগাতেন এ দেশি ব্যারিস্টাররা…এই বাড়িতে অনুশীলন সমিতির কর্মী ছাড়া অন্য কোনও দলের কর্মী থাকতেন না। নলিনীকিশোর গুহ এই দলের তরফ থেকে এই বাড়িতে থাকতেন।’ আবার স্বাধীন আন্দোলনে ‘আত্মশক্তি’ নামে একটি পত্রিকা বেশ জনপ্রিয় হয়। সেই দেশাত্মবোধক পত্রিকার নামকরণের সূত্র ধরে লিন্টন স্ট্রিটের একটি মাঠের নামকরণ করা হয় আত্মশক্তির মাঠ। এই মাঠেই স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মীদের সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হত। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত ছাব্বিশে জানুয়ারি এখানে পালিত হতো স্বাধীনতা দিবস। যতই অতীত হাতড়ানো যাবে, ততই বেরিয়ে পড়বে বেনেপুকুর অঞ্চলে ইতিহাস, নানা কাহিনী। দীর্ঘ ইতিহাস বহন করে চলেছে কলকাতার বেনিয়াপুকুর।