ব্রিটিশরা তখন বেশ জাঁকিয়ে বসেছে । প্রশাসন চালাবে চালাবে করছে । অনেক কিছুই তাঁরা নিজেদের অধীনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এসব করলেই তো শুধু হবে না, বিনোদন চাই বিনোদন। জীবনে বিনোদন না হলে কি বেঁচে থাকা যায় ! আর সে জন্যই কলকাতায় থিয়েটারের জন্ম। একাধিক থিয়েটারও গড়ে উঠল। আবার মরেও গেল সে সমস্ত থিয়েটার । দর্শকদের মনে যখন আর কোনও নাটক দাগ কাটতে পারছে না, একটার পর একটা প্রযোজনা ফ্লপ হচ্ছে, তখনই জন্ম চৌরঙ্গী থিয়েটারের। সালটা ১৮১৩। দিনটা ২৫ নভেম্বর। উদ্দেশ্য একটাই, ‘সুস্থ বিনোদন’। কলকাতার তাবড় থিয়েটারপ্রেমীরা সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন। একশো টাকা করে প্রতিটা শেয়ার। শেয়ার কিনলেই থিয়েটারের মালিকানা । কিনলেনও নাট্যরসিকরা । প্রত্যেকেই বিদেশি, শেযারহোল্ডারদের মধ্যে একমাত্র বাঙালি হলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর ।
চাঁদার মাধ্যমে থিয়েটার গড়ে উঠেছিল বলে চৌরঙ্গী থিয়েটার পরিচিত ছিল ‘সাবসক্রিপশন থিয়েটার’ নামেও। এ পরিচিতি অবশ্য থিয়েটার রসিকদের কাছে। আম আদমির কাছে ‘নাচঘর’। কলকাতার পথের নামকরণ তখন হয়নি। চৌরঙ্গীর নাচঘরে যাব বললেই রঙ্গালয়ের সামনে হাজির করতেন পাল্কি বেহারা থেকে গাড়োয়ানরা। এই ‘নাচঘর’ নামটা দীর্ঘকাল থেকে গিয়েছিল। রঙ্গালয় যখন নিশ্চিহ্ন, সে সময়ও পথ পরিচিতি নাচঘর। তাই তো বলছে, ১৮৫০ সালের বেঙ্গল অ্যান্ড আগ্রা ডিরেক্টরি—‘পুরানা নাচঘর কা উত্তর রাস্তা’। আম আদমির ‘নাচঘর কা উত্তর রাস্তা’ অবশ্য ব্রিটিশদের কাছে পরিচিত ছিল থিয়েটার রোড নামেই।
যাইহোক, রঙ্গালয়শূন্য কলকাতায় নতুন নাট্যশালা আসায় উৎসাহ আর আনন্দের অন্ত ছিল না। উদ্বোধনের দিন প্রেক্ষাগৃহ কার্যত ভেঙে পড়ল। অমল মিত্র তাঁর ‘কলকাতায় বিদেশি রঙ্গালয়’ গ্রন্থে লিখছেন—‘ভিতরে প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণের পথ প্রায় বন্ধ, বাইরে অগণিত গাড়ি ও পালকির মিছিল। প্রেক্ষাগৃহের দরজা খোলার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব দামী আসন ভর্তি হয়ে গেল। বাকী আসনগুলোও পূর্ণ হয়ে যেতে দেরি হয়নি। রাত আটটা নাগাদ সপার্ষদ লাট দম্পতী উপস্থিত হলে অনুষ্ঠান শুরু। প্রথমেই রঙ্গালয়ের ম্যানেজার সম্মানিত অতিথি ও বিশিষ্ট দর্শকদের উদ্দেশ্যে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ছোট একটি বক্তৃতা দিলেন।…এরপর অভিনয়। একটি বিয়োগান্ত নাটক ‘কাসল স্পেকটার’ ও একখানি সঙ্গীতবহুল নাটিকা ‘সিক্সটি থার্ড লেটার’ সে রাত্রিতে অভিনীত হয়েছিল। বিয়োগান্ত নাটক দিয়ে নতুন নাট্যশালার দ্বারোদ্ঘাটন হবে জেনে অনেকেই বিস্মিত হন, চিন্তিত হন। এথেনিয়াম মঞ্চে অনেকগুলি প্রথমশ্রেণীর বিয়োগান্ত নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। সাফল্যমণ্ডিত হয়নি তার একটিও। তাই তাঁদের এই দুশ্চিন্তা। কিন্তু চৌরঙ্গী রঙ্গালয়ে নিপুণ শিল্পীরা তাঁদের ধারণা দিলেন বদলিয়ে।’
সেই শুরু। এরপর চৌরঙ্গি থিয়েটারের নাম চারদিকে। অন্য নাট্যশালা থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা দলে দলে যোগ দিতে লাগলেন নতুন এই রঙ্গালয়ে। একের পর এক সুপার ডুপার হিট নাটক মঞ্চস্থ হতে লাগল। মুগ্ধ হলেন দর্শকরা । কিন্তু চৌরঙ্গী থিয়েটার লাভের মুখ দেখল না । বারবার ক্ষতির মুখ দেখতে দেখতে এক সময় হস্তান্তর হয়ে গেল এই থিয়েটার। এর প্রধান কারণ হল যে বাড়িটিতে চৌরঙ্গী থিয়েটার তৈরি হয়, সেটি ছিল একটি জরাজীর্ণ বাড়ি। আর তাই বারবার কর্তাদের বাড়ি সারাইয়ে অর্ধেক টাকা ব্যয় হয়ে যায়। ঋণের বোঝা বাড়তে থাকল। শেষ পর্যন্ত কর্মকর্তারা এক ইতালীয় অপেরা কোম্পানিকে ভাড়া দিয়ে দিলেন থিয়েটার। কিন্তু তাতে চলল না। আয়ের পথ কিছুতেই খুলল না। শেষ কালে ৩০ হাজার ১০০ টাকা মূল্যে থিয়েটার নিলামের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। আর বিদেশি এই রঙ্গালয় কিনে নিলেন এক বাঙালি ব্যবসায়ী । সুমনা দাসদত্ত তাঁর ‘ঠাকুরবাড়ির ব্যবসা’ বইয়ে লিখছেন—‘দ্বারকানাথ কোলকাতার থিয়েটার এর একজন ভক্ত ছিলেন, পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন।
এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে বলতে ১৮৩৫ সালে ১৫ই আগষ্ট চৌরঙ্গী থিয়েটার আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হলে এই থিয়েটারের মালিকেরা নিলামে বেচে দেন। দ্বারকানাথ চৌরঙ্গী থিয়েটারটি কিনে নেন, এমনকি থিয়েটারের ব্যবহৃত সমস্ত জিনিষ পত্র, কাপড় চোপড়, সিনসিনারি—থিয়েটার এর অন্তর্ভুক্ত আর সব সামগ্রী সহ থিয়েটার নিলামে কিনে নেন…’
দ্বারকানাথের কাছে থিয়েটার কেনাটা ছিল একেবারেই নিতান্তই একটি শখের ব্যাপার । আগের কর্মকর্তাদের তিনি রেখে দিলেন তাঁর নিজের চৌরঙ্গী থিয়েটারে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও দিলেন। আর দ্বারকানাথের চৌরঙ্গি থিয়েটার চলল রমরমিয়ে। ভাগ্য অবশ্য মুচকি হাসল। অবশেষে একদিন হঠাৎ করে অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন হল চৌরঙ্গি থিয়েটারের। অমল মিত্র লিখেছেন সেদিনের (৩১ মে, ১৮৩৯) কথা—‘সে রাত্রে পাইলট এবং স্লিপিং ড্রাফট-এর মহড়া শেষ করে রাত বারোটা নাগাদ শিল্পীরা ফিরে গেলেন। সকল আলোই নিবিয়ে দিয়ে একটি মাত্র আলো যথারীতি জ্বলছিল রঙ্গমঞ্চের সামনের দিকে। হঠাৎ সেক্রেটারীর চোখে পড়ল ঘন গভীর ধোঁয়ার কুণ্ডলী।’
১ জুনের বেঙ্গল হরকরায় লেখা হল প্রতিবেদন—‘…the flames made such a rapid progress that although engines arrived in the shortest possible time, they could do nothing for the preservation of the house.’;চৌরঙ্গি থিয়েটার এখন অতীত। নাচঘরের রাস্তাটাও এখন ইতিহাসে মিলিয়ে গিয়েছে । তবে এখনও বেঁচে আছে বাড়িটি। সে বাড়িতে এখন বিখ্যাত এক প্রবাসী বাঙালি সংস্থার অফিস। খোলনলচে বদলে এখনও বুকে আঁকড়ে ধরে আছে রঙ্গালয়ের ইতিহাস ।