অগাস্ট মাস। দুপুর ১টা। মালদার লোকাল বাসে কালিয়াচকের বালিয়াডাঙ্গা বাসস্টপে নামলাম আমি। মাথার ওপর সূর্য নেই। আসার পথে তুমুল একচোট বৃষ্টি হয়ে গেছে। পুরোটা থামেনি এখনও। হাল্কা টুপটাপ পড়েই চলেছে। ধোঁয়াটে মেঘে ঢেকে রয়েছে গোটা আকাশ। বাসস্টপের একধারে টিনের আটচালা একটা ছাউনি মত। তারই বাঁশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল আশরাফ। বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশ। ছিপছিপে একহারা চেহারা। সাধারণ শার্টপ্যান্ট। হাতে ছাতা। ফোনে আগেই কথা বলা ছিল। আমাকে নামতে দেখে হেসে এগিয়ে এলো সামনে। “যাক এসে গেছেন দাদা, চলেন, রওনা দেওয়া যাক তাহলে।” “হ্যাঁ চলো।” প্রত্যুত্তরে হেসে ঘাড় নাড়লাম আমি। তারপর ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করে হাঁটা লাগালাম আশরাফের পিছু পিছু।
প্রিয় পাঠক, এইখানে টুক করে একফাঁকে আশরাফের সঙ্গে পরিচয়টা করিয়ে দিই আপনাদের। আশরাফ হোসেন। চাইল্ড হেলথের ওপর কাজ করা ছোটখাটো একটি গ্রামীণ এনজিও-র কর্মী। সম্পন্ন কৃষক ঘরের ছেলে। ঘরে ধানচালের অভাব নেই। খানিকটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত। মূলত ভালোবেসেই কাজটা করে। আমি মানে এই অধম প্রতিবেদক সেসময় কলকাতায় একটি নামী সোশ্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের কর্মী। আন্তর্জাতিক একটি শিশুকল্যান সংস্থার তরফ থেকে একটা বড় প্রজেক্টের বরাত পেয়েছে আমার অফিস। সেই কাজেই এসেছি মালদায়। কালিয়াচকে আমার স্থানীয় গাইড আশরাফ। রাতে খাওয়া থাকার ব্যবস্থা আশরাফদের সংস্থার অফিসেই।
বাসরাস্তা ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো আশরাফ। দুদিকে দিগন্ত বিস্তৃত পাটক্ষেত। যদ্দুর চোখ যায় সবুজে সবুজ। প্রায় কিলোমিটার খানেক দূরে একটা ছোট একতলা বাড়ির দিকে আঙুল দেখালো আশরাফ। “ওই যে দেখছেন … ওটাই এখানকার গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ওখানেই হেলথ ওয়ার্কারদের সঙ্গে ইন্টারভিউ আপনার। বড় রাস্তা ধরে গেলে অনেকটা ঘুরপথ। ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট হবে। চলে আসেন।” অগত্যা আশরাফের পিছু পিছু হড়বড় করে নেমে পড়লাম পাটক্ষেতে এবং পরমুহুর্তেই একটা বিপুল চমকের সম্মুখীন হলাম। বাসে যেতে যেতে অথবা ওপর থেকে আলগোছে দেখা পাটগাছ যে এতটা লম্বা হতে পারে ধারনাই ছিল না আমার। উচ্চতা প্রায় দেড়-দু মানুষ সমান। আমরা তো আমরা, বিখ্যাত ডব্লু ডব্লু ই কুস্তিগীর মহাবলী খালি বা এনবিএ বাস্কেটবলের সেই সব তালগাছসম মহাতারকারাও ঢাকা পড়ে যাবেন এই পাটসমুদ্রের আড়ালে। ক্ষেতের মধ্যে এদিক ওদিক চলে যাওয়া অগুনতি শুঁড়ি থুড়ি কর্দমাক্ত আলপথ। একেবেঁকে হারিয়ে গেছে কে জানে কোথায়। ডিসকভারি চ্যানেলে ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ অনুষ্ঠানের সেই কম্যান্ডো অভিযাত্রী বেয়ার গ্রিলসকে এখানে এনে ছেড়ে দিলে তার পক্ষেও বোধহয় বেড়িয়ে আসা অসম্ভব এই গোলকধাঁধা থেকে। সঙ্গে পথপ্রদর্শক না থাকলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। কর্দমাক্ত আল পথে পা হড়কানো আর আছাড় খাওয়া সামলাতে সামলাতে কোনমতে অনুসরণ করছিলাম আশরাফকে। আশরাফ বার বার ঘুরে তাকাচ্ছিল পিছনে। “সাবধানে … সামলে আসবেন দাদা।” মুখে পরম নিশ্চিন্তির ভাব একটা। এসব রাস্তা যে ওর হাতের তালুর মত চেনা, হাবেভাবেই স্পষ্ট সেটা। আরও দু-দশ কদম এগোতেই ফের চমক! চোখের সামনে হঠাৎই যেন দপ করে ফাঁকা হয়ে গেল জায়গাটা। চারদিক ঘেরা পাটক্ষেতের মাঝখানে একর দুয়েক জায়গা জুড়ে অদ্ভুত একটা ফসলের চাষ। হাঁটু, বড়জোর ঊরুসমান শৃঙ্খলাবদ্ধ গাছের সারি। বুনো কলাবতী ফুলগাছের পাতার মত পাতা। আকারে অবশ্য অনেকটা ছোট। গাছের গায়ে এদিকওদিক গোল গোল ধুতরো ফলের মত দেখতে একধরনের ফল ধরে আছে। আর সাদা সাদা একধরণের ফুল।
প্রজেক্টের কাজে গ্রামাঞ্চলে ঘোরাঘুরি করার কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা রয়েছে। এরকম কিছু চোখে পড়েনি আগে কোনদিন। কৌতূহলী চোখে তাকালাম আশরাফের দিকে। হঠাৎই পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে শরীরটা! একটু আগে নিশ্চিন্ত ভাবটা কেটে গিয়ে চাপা একটা ত্রাসের ছাপ চোখেমুখে। চোখের ইশারায় চুপ করতে বললো আমাকে। ওর দৃষ্টিকে অনুসরণ করে চোখ গেল সামনে। উল্টোদিকের আলপথ ধরে এগিয়ে আসছে তিনজন। সামনে দুজন। আশরাফেরই বয়েসি। দুজনের কাঁধেই ডাবল ব্যারেল বন্দুক। পিছনে আরেকজন। বছর চল্লিশেক হবে। হাতে নাইনএমএম অটোম্যাটিক পিস্তল। বোধহয় দলনেতা। দেখতে দেখতে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো দলটা। তিনজোড়া চোখ আশরাফকে টপকে সরাসরি আমার দিকে। শিকারি বাজের চাহনিতে মাপছে আমাকে। “সঙ্গে কে? কোথায় যাচ্ছিস এনাকে নিয়ে?” আমার দিক থেকে একটুও চোখ না সরিয়ে বরফঠাণ্ডা গলায় আশরাফকে প্রশ্ন করলো দলের মধ্যে বয়স্ক লোকটা। “দাদা কলকাতার একটা এনজিও-তে কাজ করেন। বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের ওপর একটা কাজ নিয়ে এসেছেন এখানে। হেলথ সেন্টারের দিদিদের সঙ্গে কথা বলবেন। ওখানেই নিয়ে যাচ্ছি।” মিনমিন করে উত্তর দিল আশরাফ। কাঁপা কাঁপা একটা ভয় আটকে রয়েছে গলার মধ্যে। “পাকা রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেলি না কেন?” কথা শেষ হবার আগেই প্রশ্ন করলো আরেকজন। “এ-এখান দিয়ে গেলে শর্টকাট হয় … তাই …।” কথা আটকে যাচ্ছিল আশরাফের। শোনার পর চোখের ভাষা যেন একটু নরম হলো তিনজনের। “কাজ যে করছেন, কাগজপত্র কিছু আছে সঙ্গে?” এবার সরাসরি প্রশ্ন আমাকে। প্রশ্নকর্তা সেই বয়স্কজন। এক সেকেন্ড দেরী না করে অফিস আর ফান্ডিং এজেন্সির অথরাইজেশন লেটার মায় অফিস আই কার্ড, সবকিছু ব্যাগ থেকে বের করে তুলে দিলাম লোকটার হাতে। অনেকক্ষণ ধরে সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো লোকটা। কিছু বুঝলো বলে মনে হলো না। তবে দেখার ফাঁকে মাঝে মাঝেই চোখ তুলে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল আমার দিকে। আমার আর আশরাফের কথার সত্যতা যাচাই করে নিতে চাইছিল বোধহয়। অতঃপর ডকুমেন্টসগুলো আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ঘুরে তাকালো আশরাফের দিকে। গলার আওয়াজ অনেকটাই নরম এখন। “ফাউ (বেকার) এ পথে নিয়ে এসছিস। শহরের মানুষ … কত বিপদআপদ এ রাস্তায় … কাদা, সাপখোপ, জোঁক, তাছাড়া… যাকগে, ফেরার সময় পাকা রাস্তা ধরে ফিরবি। আর হ্যাঁ, সাবধানে নিয়ে যাবি দাদাকে। বুঝলু (বুঝেছিস)?” হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন আশরাফ। “হ্যাঁ দুলুভাই।” বলে উঠলো হড়বড় করে। “চল।” পিস্তল কোমরে গুঁজে সঙ্গী দুজনের দিকে তাকালো লোকটা। তারপর দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে। তিনজন চোখের আড়াল হতেই ঘুরে তাকালাম আশরাফের দিকে। “ব্যাপারটা কী?” “এখানে আর একটাও কথা নয় দাদা।” দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বললো আশরাফ। “রাতে অফিসে ফিরে সব বলবো।”
রাত সাড়ে নটা-দশটা মত হবে। ছোট এনজিও অফিসের কাজের টেবিলটাকে একটু ফাঁকাসাকা করে রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আয়োজন অতি সাধারণ। খিচুড়ি, আলু ভাজা আর পাটপাতার বড়া। বাইরে ফের বৃষ্টি শুরু হয়েছে অঝোরে। চড়বড় চড়বড় … বড় বড় জলের ফোঁটার অবিরাম ধারাপাত অ্যাসবেসটাসের চালে। “এবার বলো ব্যাপারটা কী ?” এক চামচ খিচুড়ি মুখে তুলে প্রশ্ন করলাম আশরাফকে। “তাহলে শোনেন …।” অতঃপর আশরাফ যা বলেছিল তা একদিকে যেমন চমকপ্রদ, একইসঙ্গে শিরদাঁড়ায় ঠাণ্ডা স্রোত নামিয়ে দেয়ার মত। যেভাবে শুনেছিলাম তারই কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি এখানে।
চারদিক পাটক্ষেত ঘেরা ওই একর দুয়েক জমিতে আসলে আফিমের চাষ হচ্ছিল। ডিসেম্বরে বীজ পোতা থেকে শুরু করে ফসল কাটতে কাটতে প্রায় মে-জুন। কাটার সময় প্রায় পেরিয়ে গেলেও জুলাই-আগস্ট অবধিও চলে এই কাটার কাজ। এখন মোটামুটি অফ সিজন। তাই চাষ একটু কম। পিক সিজনে হাজার হাজার একর জমিতে রমরমিয়ে চলে বেআইনি আফিমের চাষ। কখনও পাটক্ষেতের আড়ালে, কখনও বা খুল্লামখুল্লা। হুবহু উত্তরপ্রদেশের বরাবাঁকি বা গাজিয়াবাদের স্টাইলে। ওই ধুতরোর মত ফলগুলো আসলে আফিমের বীজ। ফল থেকে নির্গত আঠা বা ল্যাটেক্সই হল কাঁচা হেরোইনের বেস। উৎপন্ন কাঁচামাল সরাসরি এখান থেকে চলে যায় বাইরে। কলকাতা, মুম্বই, দিল্লিসহ একাধিক বড় বড় শহরের গোপন ল্যাবরেটরিগুলোয়। অতঃপর এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক। তৈরি হয় ওরিজিনাল হোয়াইট হেরোইন। কালিয়াচকে যে আঠা বা ল্যাটেক্স বিক্রি হয় ছ’হাজার টাকা কেজি দরে, ফিনিশড হেরোইন হয়ে বেরোনর পর শহরের বাজারে তার দামই চড়ে যায় পাঁচ থেকে ছ’লাখ টাকা প্রতি কিলো। এরই একটা ঝড়তিপড়তি অংশের সঙ্গে র্যাট কিলারসহ একাধিক বিষাক্ত রাসায়নিক মিশিয়ে তৈরি হবে কমদামি ‘ব্রাউন সুগার’। যাকে ছেলেবুড়ো সবাই চেনে ‘পাতা’ নামে। অফিস উৎপাদন থেকে শুরু করে শহরের ক্যুরিয়ারদের হাতে তুলে দেয়া পর্যন্ত এই সমস্ত প্রক্রিয়াটাই চলে ড্রাগ মাফিয়াদের প্রাইভেট আর্মির তত্ত্বাবধানে। দুপুরবেলা যাদের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছিল আমাদের। যেহেতু কাঁধে রাইফেল বা মাস্কেট থাকে সে কারনেই এই দুর্বৃত্তদলকে ‘মাস্কেট বাহিনী’ বা ‘হনুমান বাহিনী’ নামেও ডাকা হয়। উল্লেখযোগ্য, মালদা – মুর্শিদাবাদ – নদিয়া … এই পুরো অঞ্চল জুড়ে বন্দুক বা মাস্কেটের কোডনেম ‘হনুমান’।
আশরাফের বয়ানে ড্রাগ ছাড়াও তিনটে ব্যবসার ফলাও কারবার কালিয়াচকসহ গোটা মালদা, বিশেষত ভারত – বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলো জুড়ে। জালনোট, গরু এবং অস্ত্রপাচার। প্রথমে আসা যাক জালনোটের কথায়। পাঁচশো, একহাজার টাকার জালনোট। রাতের অন্ধকারে মজবুত পলিথিনের প্যাকেটে প্যাক করে কাঁটাতার টপকে ছুঁড়ে দেয়া হয় এপারে। এপারে অপেক্ষায় থাকে ক্যুরিয়ার। প্যাকেট তুলে নিয়েই পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোন লাগায়। “ল্যাংড়া পড়েছে!” (এখানে পাঁচশো টাকার নোটের কোডনেম ‘ল্যাংড়া’ আর এক হাজার টাকার নোট ‘ফজলি’। জাতীয় ফলের নামের কী সার্থক ব্যবহার!) কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘটনাস্থলে এসে হাজির মোটরবাইক। বাইকে চেপে সিধে কালিয়াচক বাসস্ট্যান্ড অথবা ফারাক্কা রেলস্টেশন। নইলে ডাঙ্গা, মানিকচকসহ একাধিক নদীঘাট। ট্রেন, বাস, নৌকো, ভুটভুটিতে চেপে মাল পৌঁছে যাবে মুম্বই, দিল্লি, কলকাতা, বিহার, ঝাড়খণ্ড … ছড়িয়ে পড়বে গোটা দেশে। আজ থেকে বছর দশ-বারো আগেকার কথা। আশরাফের কথায় সেসময় ভারতীয় আসল ত্রিশ হাজার টাকায় জাল এক লক্ষ টাকা পাওয়া যেত। এখন শুনছি সেটা পঞ্চাশ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
অতঃপর গরু পাচার। সেটি যে কী বিষম বস্তু, দেখেছিলাম আশরাফদের অফিসের জানলা থেকেই। একটু রাত বাড়তেই খুটখুট খুড়ের শব্দ কাঁচাপাকা অথবা মোরামের রাস্তা জুড়ে। পালে পালে গরু চলেছে। থেকে থেকে মৃদু গলায় তাড়া দেয়া ডাক – “হ্যাট হ্যাট।” গরু একা যাবে না। ভাগ্নে মদনের মত সঙ্গে যাবে ফেভিকল, ডেনড্রাইট, কোরেক্স, ফেন্সিডিল … অ্যাডহেসিভ আর কাশির সিরাপ। বাংলাদেশের (এখানেও) নেশারুদের খুব প্রিয়। হেরোইনের বিকল্প। গরুর পেটে সেঁটে দেওয়া হবে মজবুত গজটেপ দিয়ে। ক্যামুফ্লেজ করতে ধুলোকাদা আর প্রাকৃতিক রঙ মাখিয়ে দেয়া হবে। সাদাচোখে খুব সামনে থেকে দেখেও ধরার উপায় নেই। উত্তরবঙ্গ, গৌড়বঙ্গ … সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারের কাছাকাছি বিশাল বর্ডারের মধ্যে এক হাজার কিলোমিটারের বেশি এলাকা কাঁটাতারহীন। অরক্ষিত। প্রায় লাখদেড়েক পরিবারের বাস এই বিস্তীর্ণ অরক্ষিত অঞ্চল জুড়ে। নাগরিকত্ব বা পরিচয়পত্রের ব্যাপারটা যথেষ্ট ঘাঁটা এখানে। কারও ঘর ভারতে তো রসুইঘর বাংলাদেশে, চাষের জমি ওপারে হলে শৌচাগার এপারে। এগুলোই যাকে বলে গিয়ে গরু পাচারকারীদের ‘মোস্ট ফেভারিট রুট’। এখানকার অনেক পরিবারই এই গরুপাচার থুড়ি ‘ব্যবসার’ সঙ্গে যুক্ত। এই বাড়িগুলোই পাচারকারীদের সেফ শেল্টার কাম ট্রানজিট পয়েন্ট। ছয় থেকে পনেরো হাজার টাকায় পঃবঙ্গ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা থেকে কেনা গরু বাংলাদেশে ওখানকার কারেন্সিতে দেড় লাখ অবধি পৌঁছোয় কখনো কখনো। লাভের বহরটা ভাবুন একবার মনে মনে।
শেষমেষ পড়ে রইল আর্মস স্মাগলিং। গোদা বাংলায় অস্ত্র পাচার। সমুদ্রপথে চট্টগ্রামের কক্সবাজার থেকে ভারতের সীমানা পেরোনর শেষ ঠিকানা কালিয়াচকসহ গৌড়বঙ্গের একাধিক ব্লক। ত্রিশ-বত্রিশ হাজারি জালি মুঙ্গেরি নাইনএমএম নয়। আসলি চাইনিজ মেড নাইন মিলিমিটার অটোম্যাটিক পিস্তল। সতেরো থেকে চব্বিশ রাউন্ড বুলেট একনাগাড়ে র্যাপিড ফায়ার করা যায়। এঁচিপেচি গুণ্ডাবদমাশ নয়। এ মালের খদ্দের আরও উঁচুদরের খলিফারা। দামও অনেক বেশি। এক থেকে দেড় লাখ অবধি পৌঁছোয় খদ্দের আর মওকা বুঝে।
ড্রাগ থেকে শুরু করে জালনোট, গরু হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র, সবকটা মাস্কেট বাহিনীর তদারকি আর কঠোর নিরাপত্তা বলয়ের মধ্য দিয়ে। নিরাপত্তা বাহিনীর রেইডে মাঝেমধ্যে মাল ধরা পড়ে। ক্যুরিয়র আর মাস্কেট বাহিনীর সৈন্যসামন্তরাও গ্রেফতার হয় মাঝেমধ্যে। ছমাস – এক বছর মেয়াদ খেটে বেরিয়ে এসেই ফের যে কে সেই। ধান্দার মাফিয়া কিংপিনরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরেই।
সবশেষে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য –
১) ক্রস বর্ডার ক্রাইম থেকে অর্জিত এই বিপুল অর্থের একটা বড় অংশই কিন্তু চলে ফেক কারেন্সি অর্থাৎ জাল নোটে। যে কোনও ক্ষেত্রেই লেনদেন হোক না কেন, শেষ অবধি পুরো জাল টাকাটাই ‘রি-সাইক্লিং’ হয়ে চলে আসে ভারতে।
২) উঃ ২৪ পরগনা থেকে দার্জিলিং – এই বিশাল অঞ্চলে উপরোক্ত চারটি অপরাধের সাত শতাংশই নাকি সংঘটিত হয় কালিয়াচকে। ব্রাজিলের ডাউনটাউন, মুম্বইয়ের ডোঙ্গরি-নাগপাড়া-বাইকুল্লা, আমেরিকার ঘেটো অর্থাৎ স্লাম এরিয়া, আফগানিস্তান, মায়ানমার বা কলম্বিয়া নয়। আমাদের এই পঃবঙ্গেরই ছোট্ট একটা ব্লকে। সেই কালিয়াচক, যেখানে বেশিরভাগ উঠতি ছেলেপুলেরা গোঁফের রেখা গজানোর আগেই এই চার ধান্দার একটাকে ধরে নিয়ে কিছু ‘কুইক মানি’ কামিয়ে নিতে চায়। সেখানে আশরাফের মত মানুষদের সৎপথে কিছু করেকম্মে খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টাচরিত্তির কদ্দিন টিকে থাকবে কে জানে? প্রায় একযুগের ওপর হয়ে গেল। অনেকদিন যাওয়া হয়নি ওদিকটায়। কিন্তু কাগজপত্রে যা খবর পাই সেটা বিশেষ আশাব্যঞ্জক নয়। মোদিজীর নোটবন্দিতে কী অষ্টাবর্গ ফল লাভ হয়েছে জানি না, তবে সরকারি নোট ছাপাখানার নতুন নোট ছাপানোর মেশিনের কালি শুকোবার আগেই ওইসব অঞ্চল থেকে উদ্ধার হয়েছে কড়কড়ে দুহাজার টাকার নোট। জাল যথারীতি। ওপারে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে অগুনতি ওয়ার্কশপ। প্রতিদিন। জাল নোটের কটেজ ইন্ডাস্ট্রি। ফলে ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাইয়ের সমস্যা বলতে গেলে নেই একেবারে। আরও একটি উদ্বেগজনক খবর। মাত্র বছরখানেক আগে এক বিপুল হিংসাশ্রয়ী জনতা আক্রমন চালায় কালিয়াচক থানায়। তাণ্ডব চালিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় নথিপত্র। মাদক পাচার সংক্রান্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রও ছিল তার মধ্যে। স্থানীয় একাংশের মতে ড্রাগ মাফিয়াদের উস্কানি ছিল এর পিছনে। সেক্ষেত্রে সন্দেহের অবকাশটা কিন্তু রয়েই গেল।
(স্বাভাবিক কারনেই আশরাফের আসল নামটা গোপন রাখা হল এই প্রতিবেদনে।)
তথ্যসুত্র –
টাইমস অফ ইন্ডিয়া, হিন্দুস্থান টাইমস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, টেলিগ্রাফ,
আউটলুক সহ বিভিন্ন সময় প্রকাশিত একাধিক পত্রপত্রিকা।
অন্তর্জাল সুত্রে প্রাপ্ত বি এস এফ সহ একাধিক নিরাপত্তা বাহিনীর রিপোর্ট।
কর্মসূত্রে এই অধম প্রতিবেদকের ওইসব অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাতায়াত এবং একাধিক মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা ও উত্তরদাতাদের সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা।