অবশেষে জট কাটল। সোমবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী-জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে ঘন্টা দেড়েকের বৈঠকে সমাধান সূত্রও মিলল। ধরেই নিতে হবে বৈঠক সফল হয়েছে। তা না হলে এনআরএসে ফিরে কেন আন্দোলন প্রত্যাহার করবেন জুনিয়র ডাক্তাররা। নিরাপত্তার দাবি নিয়ে শুরু হওয়া সোমবারের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জুনিয়র ডাক্তারদের সব ব্যাপারেই বরাভয় দিয়েছেন।
বৈঠকের আগে ডাক্তারদের দাবি মেনে লাইভ কভারেজের অনুমতিও দেন মুখ্যমন্ত্রী। এনআরএসের জুনিয়র ডাক্তারদের ১২ দফার দাবিপত্রের প্রায় প্রতিটি দাবিই মেনে নেন তিনি। জুনিয়র ডাক্তাররাও নবান্নের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে নির্দ্বিধায় একরাশ অভিযোগ হাজির করেন। মুখ্যমন্ত্রী তাদের তোলা সমস্ত অভাব-অভিযোগ মন দিয়ে শোনেন এবং সব রকমের আশ্বাস দেন।
এদিনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তারদের পাশাপাশি, পুলিশ, হাসপাতাল অধ্যক্ষদের সঙ্গেও কথা বলে নবান্ন থেকেই জানান, যে হাসপাতালগুলিকে একটা নির্দিষ্ট সিস্টেমের আওতায় আনতে হবে, থাকতে হবে গ্রিভান্সার সেল। যেখানে অভিযোগ জানাতে পারবে রোগীর পরিবারেরা। কোনওরকম ঝামেলা হলেই তৎক্ষণাৎ অ্যাকশন নিতে হবে, মুখ্যমন্ত্রী ওই বিধান দেওয়ার পরই জুনিয়র ডাক্তাররা প্রতিটি হাসপাতালে সমস্যা সমাধানের জন্য কমিটি গঠনের দাবি জানান। মুখ্যমন্ত্রী সেই দাবি মেনেও নেন। সেই সঙ্গে রোগীকল্যান কমিটিকে কার্যকর করার নির্দেশও দেন তিনি। জেলায় একটি করে হস্টেল করার প্রতিশ্রুতিও দেন মুখ্যমন্ত্রী। উল্লেখ্য, এদিন নীলরতনের ডাক্তার নিগ্রহের ঘটনা মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরে জুনিয়র ডাক্তাররা অভিযোগ করেন ঘটনার সময় দু-জন পুলিশ থাকলেও কোনও অ্যাকশন নেয়নি।
মুখ্যমন্ত্রী তার উত্তরে পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মাকে যে পুলিশ সেদিন দায়িত্বে ছিল তাকে বার করে দেওয়ার আদেশ করেন। জুনিয়ার ডাক্তার পরিবহ মুখোপাধ্যায়ের উপর হামলার জেরে জুনিয়র ডাক্তারদের লাগাতার
আন্দোলনের মূল দাবি ছিল রাজ্যের চিকিৎসকদের কর্মস্থলে সুরক্ষা। পাশাপাশি তারা সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবার প্রতিবন্ধকতাকেও সামনে আনতে চেষ্টা করেছিলেন। তাদের দাবি অনুযায়ী নিরাপত্তা নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় পুলিশ, প্রশাসনকে। সোমবার নবান্নের বৈঠকে জুনিয়র ডাক্তারেরা সেই নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জবাব চান। তাদের প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী ১০ দফায় নিরাপত্তা নেওয়ার কথা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। আর সোমবার জানান সময় লাগলেও জরুরি বিভাগে কোলাপসিবল গেট বাননো হবে। তাছাড়া জরুরি বিভাগে রোগী এসে পৌঁছলে তার সঙ্গে রোগীর পরিবারের দুজনকে রাখার ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী। এর পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী এদিন কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে হাসপাতালগুলির জন্য আলাদা আলাদা প্যাকেজ করার পরামর্শ দেন। হাসপাতাল পরিদর্শনের জন্য রুরাল অফিসার এবং জেলায় জেলায় নোডাল অফিসার মোতায়েন করার কথাও বলেন। এমনকি রাতের বেলায় হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে যথাযথ করতে বেসরকারি সংস্থা থেকে আলাদা নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করার পরিকল্পনা করেন মুখ্যমন্ত্রী।
সবই হল অথচ এনআরএস কাণ্ডের জেরে জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলনে রাজ্য জুড়ে চিকিৎসা সংকট। সংকট মেটাতে ডাক্তার বনাম প্রশাসনের ইগোর লড়াই। দু পক্ষই অনড়। কেউ কারও অহং থেকে এক পা নড়বেন না। এই দড়ি টানামানির মাঝে পড়ে চিকিৎসা পেতে কত মানুষ যে অসহায় পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন তার পরিসংখ্যান নেই। আর চিকিৎসা না পেয়ে শিশুসহ কত জন শহরে গঞ্জে মরেছেন? সেই হিসাবও আপাতত থাক। এখনো ৯০ শতাংশ মানুষ সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। অসুখ-বিশুখে ডাক্তারবাবুর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই। সেই সরকারি হাসপাতালের একটু চিকিৎসা পেতে, একটা বেড পেতে, দূর দূরান্ত থেকে রোগীকে সঙ্গে নিয়ে তার বাড়ির লোককে হাসপাতালের এধারে ওধারে হত্তে দিতে হয়। ডাক্তারবাবুদের মুখঝামটা শুনতে হয়, দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হয়, এছাড়া হয়রানি তো আছেই। তারপর আর রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার বেহাল দশার পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটার মানে হয় না।
চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু মিছিল চলছে । তারপরও গোঁ ধরে বসে আছেন মুখ্যমন্ত্রী। অনড় আন্দোলনকারীরা। শেষ পর্যন্ত জেদ ভাঙল কিন্তু চিকিৎসা না পেয়ে মরল সাধারণ মানুষ। এতগুলি মৃত্যুর দায় নেবে কে? জেদ…অহং…ইগো…? এত অহং, কিসের এত জেদ, বা ইগো ? আর সেই জেদ-অহং-ইগোর জন্য সাধারণ মানুষ মরবে, হয়রান হবে ? একটু নমনীয় মনোভাব নিলে মহাভারত কি অশুদ্ধ হত ? এতগুলি মৃত্যু তো এড়ানো
যেত ।
মুখ্যমন্ত্রী এনআরএস-এ না গিয়ে যে এসএসকেএম-এ পৌঁছলেন এবং জুনিয়ার ডাক্তারদের হুমকি, হুঁশিয়ারি দিলেন সে প্রশ্ন তো সংগত। জুনিয়ার ডাক্তাররা যে বহিরাগত নয়, তারা পদবী দেখেও যে চিকিৎসা করেন না এসব প্রশ্ন সরকারি দপ্তর নবান্নতে এসেই মুখ্যমন্ত্রীকে করা যেত। কেন মুখ্যমন্ত্রী আহত জুনিয়ার ডাক্তার পরিবহকে দেখতে এলেন না সেই প্রশ্নটিও? এতে কিন্তু জেদ- অহং-ইগো বাড়ত বই কমত না। সাধারণ মানুষ ডাক্তারবাবুদের সত্যি ভগবান মানত।
বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মেট্রো চ্যানেলে ২৬ দিন অনশনে বসে রাজ্য সরকারকে নাস্তানাবুদ করেছিলেন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী একাধিকবার অনশন তোলার প্রস্তাব পাঠালেও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। রাজ্যপালের অনুরোধে তিনি একাধিকবার রাজভবনে গিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন। এমনকি একবার রাজভবন থেকে দীর্ঘ আলোচনা সেরে বেরিয়ে যাওয়ার পর পথের মাঝখানেই তাঁকে রাজ্যপাল ডেকে পাঠান। তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে ফের রাজ্যপালের অনুরোধ রক্ষা করেন । এতে কিন্তু অন্তত সেদিন অহং বা ইগো ধুলায় লুণ্ঠিত হয়নি কারও । ডাক্তারদের কাছে সাধারণ মানুষকে যেমন যেতেই হয় তেমনি ডাক্তারবাবুদেরও সেই মানুষগুলি ছাড়া চলে না। রাজ্যের যে কোনও মানুষ তিনি ডাক্তার কিংবা রোগী যেই হন মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু সবারই ।
8 Responses
ডাক্তারা মার খায়, আন্দোলন হয়, ঠাণ্ডা ঘরে বৈঠক বসে…সবই তো হয় তবু সাধারণ মানুষের কেন যে এত মরণ হয় কে জানে!
ডাক্তারদের কেন মার খেতে হবে রোগীর বাড়ির লোকের হাতে? কেনই বা চিকিতসা নিতে এসে রোগীর বাড়ির লোককে নাকাল হতে হবে, ডাক্তারদের খারাপ ব্যবহার মাথা পেতে নিতে হবে? ডাক্তারের কি রোগী ছাড়া চলবে না ডাক্তার ছাড়া মানুষের চলবে? নবান্নে এসব একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক।
জুনিয়ার ডাক্তার না থাকলে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার হাল যে কি হবে সে ধারণা অনেকেরই নেই।
ডাক্তাররা যাদের চিকিৎসা করবেন তারাই আবার ডাক্তারদের পেটাবেন এ কেমন কথা, কিন্তু তার চেয়ে চমৎকার ডাক্তারদের পরিসেবা চালিয়ে যেতে হবে।
ডাক্তার নিগৃহীত হলে তাদের গর্জে ওঠাই স্বাভাবিক আবার তাদের কর্মবিরতিতে কিভাবে যে গরিব মানুষ মরে আর সাধারণ মানুষ সরকারি পরিষেবা না পেয়ে নাকাল হয় সেটা বুঝেও কি আক্কেল হবে? তা না হলে ওসব বৈঠক ফইঠক কোনও কামে আসবে না। শবসানে যেমন শান্তি বিরাজ করে আশবাসও তেমনি।
চিকিৎসকদের আন্দোলনে কোনও রাজনীতি ছিল না বলে অনেক মানুষ খুশী হয়েছিলেন, তাদের আন্দোলনে যাতে কোনও রাজনীতির ছোঁয়া না লাগে সে কথা বলতেও ভোলেন নি। আন্দোলন কি আকাশ থেকে নামে, নাকি নেতৃত্ব ছাড়াই আন্দোলন এগিয়ে যায়?
চমৎকার বিশ্লেষণ।
কোন পক্ষে বললেন; ডাক্তার-প্রশাসন না নিরপেক্ষ ঠিক বোঝা গেল না।